ডেভ হোয়াটমোর আর চন্ডিকা হাথুরুসিংহের কথা যতই বলা হোক না কেন, ঐ দুই ভিনদেশি কোচের প্রশংসা ও বন্দনায় কেউ কেউ যতই মেতে থাকুন না কেন, আসল সত্য হলো মাশরাফির নেতৃত্বেই বদলে গেছে বাংলাদেশ। ‘আমরা পারি। আমাদের সামর্থ্য আছে ভালো করার। নিজেদের চেয়ে কাগজে কলমে শ্রেয়তর দলের সঙ্গে প্রাণপণ লড়ে ম্যাচ জেতার পর্যাপ্ত ক্ষমতাও আছে।
এই সাহস, উদ্দীপক দাওয়াটা সবাইকে গুলিয়ে খাইয়ে দিয়েছেন মাশরাফি। নিজেদের ক্রিকেটীয় সামর্থ্যের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসটাই মাঠে ব্যাট ও বল হাতে ভালো করার সবচেয়ে বড় রসদ। মাশরাফি সেই কার্যকর রসদ সরবরাহকারী।
আগের যে কোন সময়ের চেয়ে টিম স্পিরিট অনেক বেশি। টিম পারফরমেন্সও হচ্ছে প্রায় নিয়মিত। এক কথায় তামিম, ইমরুল, সৌম্য, সাকিব, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ, নাসির, সাব্বির, মিরাজ, মোস্তাফিজ, শফিউল, রুবেল ও তাসকিনদের নিয়ে জাতীয় দলকে একটা পরিবারে পরিণত করে ফেলেছেন মাশরাফি।
পারফরমার হিসেবে সাকিব, তামিম ও মুশফিক তাকে ছাড়িয়ে গেলেও দল নেতা হিসেবে এখনো কেউ মাশরাফির সমকক্ষ নন। তাদের কারো গ্রহণযোগ্যতাও মাশরাফির মত নয়। সিনিয়র-জুনিয়র আর শিক্ষানবিস- সব ক্রিকেটারই মাশরাফি ভাই বলতে অন্ধ। কারণ তারা সবাই জানেন, মাশরাফি ভাই ক্লাবে, হোটেলে, প্র্যাকটিসে, খেলার মাঠে আর ড্রেসিং রুমে সবচেয়ে বড় আপনজন। তাদের নির্ভরতা ও আস্থার জায়গা। তাই অধিনায়ক হিসেবে সবার প্রথম পছন্দ নড়াইলের ৩৪ বছর বয়সী এ সাহসী যুবা।
শুধু নেতৃত্ব গুণের কথা বলা কেন, সাফল্যের মানদণ্ডেও মাশরাফি সবার ওপরে। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ওয়ানডে জেতা দলের অধিনায়কের নাম মাশরাফি। তার সুযোগ্য নেতৃত্বেই ৫০ ওভার ফরম্যাট তথা একদিনের দু দুটি বিশ্ব আসরে আগের যে কোন সময়ের চেয়ে ভালো খেলেছে বাংলাদেশ। ২০১৫ সালে প্রথমবার কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত গেছে। আর এই গত জুনে ইংল্যান্ডে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল খেলেছে বাংলাদেশ।
তার নেতৃত্বেই ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ে, ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে প্রথমবার চার চারটি একদিনের সিরিজ বিজয়ের দূর্লভ কৃতিত্বও হয়েছে অর্জিত। দলকে এক সুঁতোয় গেথে ফেললেইতো আর সাফল্য ধরা দেয় না। মাঠে ভালো খেলে সময় পরিবেশের ডিমান্ড অনুযায়ী পারফরমেন্সও খুব জরুরি। সেখানে একজন অধিনায়কের ভূমিকাও খুব জরুরি। অধিনায়ক মাশরাফি সে কাজগুলোও করে দেখিয়েছেন দক্ষতার সঙ্গে।
প্রতিপক্ষের শক্তি ও সামর্থ্য আর উইকেটের চরিত্র বুঝে দল সাজানো, সময় মত সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া, বোলিং পরিচালনা, ফিল্ডিং সাজানো এবং পরিবেশ পরিস্থিতি ও প্রতিপক্ষ দলের বোলিং শক্তির কথা মাথায় রেখে ব্যাটিং অর্ডার সাজানো এবং তড়িৎ ব্যাটিং অর্ডারে রদবদলের কাজেও মাশরাফির কার্যকরিতা প্রমাণিত।
শুধু জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবেই নয়। ঢাকার ক্লাব ক্রিকেট আর বিপিএলেও মাশরাফির সাফল্য তাই তুঙ্গে। ক্রিকেটার-মানুষ মাশরাফির পাশাপাশি তাই অধিনায়ক মাশরাফিও সবচেয়ে জনপ্রিয়। ক্রিস গেইল, ব্রেন্ডন ম্যাককালাম আর থিসারা পেরেরার মত বড় মাপের ক্রিকেটাররাও অধিনায়ক মাশরাফির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আর এবারের বিপিএলে মাশরাফির বৃহষ্পতি যেন তুঙ্গে।
প্রতি ম্যাচে তার অধিনায়কত্ব হচ্ছে প্রশংসিত। কখনো বল হাতে আবার কোন সময় বোলিংয়ে সময়মত জ্বলে উঠে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার নেতৃত্বে রংপুর রাইডার্স সেরা চারের ভেতরে আছে। এখনো সেমিফাইনাল শতভাগ নিশ্চিত না হলেও লিগ টেবিলে মাশরাফির দলের অবস্থান ভালো। মাঠের পারফরমেন্সে অতিনাটকীয় পতন নেমে না আসলে হয়তো সেরা চারে থাকবে মাশরাফির দল।
এবারের বিপিএলে বোলিংয়ের পাশাপাশি প্রায় খেলাতেই ব্যাট হাতেও জ্বলে উঠছেন মাশরাফি। দুটি ম্যাচে তার ব্যাটই রংপুরকে জিতিয়েছে। এবারের আসলে এখন পর্যন্ত অন্তত তিনটিতে দল জেতানোয় মাশরাফির অবদান ছিল অনেক। প্রথম ঘটনাটি ২০ নভেম্বর রাতের। শেরে বাংলায় হওয়া ঐ ম্যাচে রংপুর জিতেছে ৭ রানে। সেখানে মাশরাফির ভূমিকা যথেষ্ঠ। নিশ্চিত জয়ের দোরগোড়ায় তখন নাসিরের দল। চার ওভারে সিলেট সিক্সার্সের জিততে দরকার মোটে ৩৫। ওভার পিছু নয় রানেরও কম। হাতে ৭ উইকেট। সেটাই শেষ নয়। তার চেয়ে বড় কথা উইকেটে ক্রিজে তখন দুই সেট ব্যাটসম্যান সাব্বির ও নাসির , যারা তার আগেই শতরানের পার্টনারশিপ গড়ে জয়ের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন। এমন অবস্থায় মাশরাফি বল করতে এসে ১৭ নম্বর ওভারে দিলেন মাত্র ২ রান। তাতেই এক লাফে নয়ের কম থেকে সিলেটের ওভার পিছু লক্ষ্য মাত্রা বেড়ে দাঁড়ালো ১১ তে।
এরপর কভারের আশপাশে এবং পয়েন্টে চিতাসম ক্ষিপ্রতায় দুটি দারুণ ফিল্ডিং করে নিশ্চিত বাউন্ডারি বাঁচিয়ে প্রকারন্তরে দলের সাফল্যর রুপকার মাশরাফি। ঐ দুটির একটি বাউন্ডারি হয়ে গেলেও হয়ত ম্যাচের চালচিত্র ভিন্ন হতে পারতো।
এরপর চট্টগ্রামে পর পর দুই ম্যাচে রংপুরের জয়ের নায়ক মাশরাফি। প্রথমটি ২৫ নভেম্বর। চিটাগাং ভাইকিংসের বিপক্ষে ১৭৭ রানের বিরাট স্কোরের পিছু ধেয়ে হঠাৎ তিন নম্বরে নেমে পড়লেন মাশরাফি। মূলত পেস বোলার, তার ব্যাটিং পজিসন আসলে সাত থেকে আট নম্বর। সেই জায়গায় প্রায় সারা বছর ব্যাট করা একজন গেইল-ম্যাককালামের পাশে তিন নম্বরে নেমেও যে ব্যাট হাতে ঝড় তুলতে পারেন, প্রতিপক্ষ বোলিংকে দুমরে মুচরে দল জেতাতে পারেন, তা মাশরাফি করে দেখালেন ১৭ বলে ৪২ রানের হ্যারিক্যান ইনিংস খেলে।
এটাই শেষ নয়। গত ২৮ নভেম্বর সিলেট সিক্সার্সের সঙ্গে ইংলিশ পেসার ব্রেসন্যানের করা শেষ ওভারের ছক্কা হাকিয়ে দল জিতিয়ে আবার হিরো মাশরাফি।