২০১২ এবং ২০১৫ সালে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের মধ্যকার সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। যার মাধ্য দিয়ে সমুদ্রে সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের। আর ২০১৫ সালে ভারতের লোকসভায় পাস হয় বাংলাদেশ-ভারত স্থল সীমান্ত চুক্তি বিল। এর মধ্য দিয়ে ৬৮ বছরের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত স্থল সীমান্ত বিশ্বে প্রথমবারের মতো শান্তিপূর্ণ উপায়ে চিহ্নিত হয়। আর এবার বাংলাদেশের আরেক সীমান্তবর্তী প্রতিবেশী মিয়ানমারের সঙ্গে স্থল সীমান্ত চুক্তি সংক্রান্ত সম্পূরক সীমান্ত প্রটোকল সই করেছে। যার মাধ্যমে জলে ও স্থলে পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র পেল বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এবং মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলরের কার্যালয়ের পক্ষে দেশটির ইউনিয়ন মন্ত্রী কিয়াও সউইঅলসো দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এ চুক্তিতে সই করে। আসেম সম্মেলনে যোগ দিতে গত ১৯ নভেম্বর মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে যান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। আসেম সম্মেলনে যোগদানের পাশাপাশি মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে করেন তিনি। এ বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তির পাশাপাশি নাফ নদীর স্থায়ী সীমান্ত নির্ধারণে সম্পূরক সীমান্ত প্রটোকল চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
১৯৯৮ সালে নাফ নদীকে কেন্দ্র করে সীমানা নির্ধারণের জন্য আবারও এটি অনুসমর্থন করা হয়। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ দুই দেশের সম্মত সম্পূরক সীমান্ত প্রটোকল সই করতে সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে মিয়ানমারকে চিঠি পাঠায়। সেই চিঠির উত্তর ২০১৫ সালের ১৫ এপ্রিল পাঠায় দেশটি। সে চিঠিতে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে এ প্রটোকলটি সই করতে রাজি বলে জানানো হয়। শুধু আনুষ্ঠানিকতার অপেক্ষায় ঝুলে ছিল চুক্তিটি। এবার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের মধ্য দিয়ে এটি সই হল।
সম্পূরক সীমান্ত প্রটোকল সইয়ের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ১৯৬৬ সালের ২৮ এপ্রিল তত্কালীন পাকিস্তান এবং বার্মার মধ্যে প্রথম স্থল সীমান্ত চুক্তিটি হয়। আর এর সম্পূরক সীমন্ত প্রটোকল সই করতে ২০০৭ সালে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সব চূড়ান্ত করে মিয়ানমারকে পাঠানো হয়। তারই প্রেক্ষিতে তারা প্রটোকল সইয়ে রাজি জানিয়ে চিঠি দিয়েছে। আর এবারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরে এটি সইয়ের মধ্য দিয়ে সীমান্ত চুক্তির দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান হলো। ফলে এ চুক্তির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্থল সীমান্ত সম্পূর্ণভাবে চিহ্নত হলো। আর ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রবিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে সেখানেও বাংলাদেশের সীমানা চিহ্নত হলো। কোনো ধরনের রক্তপাত ছাড়াই দুই প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সীমান্ত নির্ধারণ সম্পন্ন করলো বাংলাদেশ।
কূটনীতিকদের মতে, মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ, মাদক চোরাচালান, দেশটির সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দাদের দ্বারা বাংলাদেশি জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেয়াসহ কিছু বিষয়ে বাংলাদেশের অসন্তুষ্টি রয়েছে। কিন্তু বিষয়গুলো কূটনৈতিক পর্যায়ে আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধান সম্ভব। অনাস্থার সংকট কাটিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ। এ প্রটোকলটি সই হলে দুই দেশের মধ্যে সীমান্তে কাটাতারের বেড়া নির্মাণ, সীমান্ত পিলার নির্ণয় ও নতুন পিলার স্থাপন, সীমান্ত পিলার রক্ষণাবেক্ষণসহ অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়ন, বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন এমআরও ন্যাশনাল পার্টির প্রশিক্ষণ বন্ধ, সীমান্ত দিয়ে মাদক ও মাদকদ্রব্য, রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধান, অবৈধ অস্ত্রের চোরাচালান বন্ধের পাশাপশি নিরাপত্তা ইস্যুতে সম্পর্ক আরো উন্নয়ন হবে বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, মিয়ানমার বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী দেশ হলেও দেশটির সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে বাংলাদেশের কোনো বিরোধ নেই। ফলে দ্রুত সম্পূরক সীমানা প্রটোকল অনুসমর্থন করতে চেয়েছিল বাংলাদেশ। তার প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ৩১ আগস্ট বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে অষ্টম পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে (এফওসি) পররাষ্ট্র সচিব পদমর্যাদার মিয়ানমারের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউ থান্ট কিয়াওয়র বাংলাদেশ সফরে এসে সিলেট জেলা ঘুরে দেখেন। তার সঙ্গে আসা প্রতিনিধি দলটি সিলেটের তামাবিল, জাফলং ও চা বাগানসসহ দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখেন। এ সময়ে প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সীমান্ত এলাকাও পরিদর্শন করেন। প্রতিনিধি দলটি সফরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সীমান্ত ব্যবস্থাপনা এবং শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানের বিষয়গুলো ঘুরে দেখেন।