১৯৭১-এ রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারী ও ফটিকছড়ির বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে মানুষের সামনে মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল যে মানুষটি; তার নামই খোকন। বর্তমানে বাংলার মানুষ যাকে ’সাকা চৌধুরী’এই এক নামে চেনে। সাকা চৌধুরী অর্থাৎ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। ওরফে রাজাকার সাকা।
উত্তর চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ’৭১ সালে রাজাকার সাকার ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের পেছনে এক বিরাট ভূমিকা রয়েছে সাকার বাবা ফকা চৌধুরীর। ফকা চৌধুরী মানে ফজলুল কাদের চৌধুরী। ফকা চৌধুরী ছিলেন পাকিস্তানিদের পা-চাটা। এই পা চাটাচাটির কারণে ১৯৬২ সালে পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ফকাকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার বানিয়ে দিয়েছিলেন। দু-একবার পাকিস্তানের একটিং প্রেসিডেন্টও হন ফকা।
পূর্ববাংলার ৭ কোটি বাঙালিকে পুরোপুরি পাঞ্জাবিদের পা-চাটা বানাবার স্বপ্নে বিভোর সে ফকা যখন দেখলেন যে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালিরা ১৯৭১-এ মুক্তির যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাধের পাকিস্তানকে নাস্তানাবুদ করে দিচ্ছে, তখনই ফকার মাথা গেল বিগড়ে। তিনি হয়ে উঠলেন বৃহত্তর চট্টগ্রামের আতঙ্কের দানব। তার বাড়ি চন্দনপুরার গুড্সহিল হলো স্বাধীনতাকামী বাঙালির ‘মৃত্যুপুরী’, টর্চার শেল। সে মৃত্যুপুরীর কমান্ডার হলেন ফকা নিজে। ডেপুটি কমান্ডার হলেন তার পুত্র সাকা।
সাকা গুড্সহিল মৃত্যুপুরীর সেকেন্ড ইন কমান্ড হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তিনিই ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন উত্তর চট্টগ্রামে। উত্তর চট্টগ্রামের কোনো কোনো পরিবারে এখনও সাকার নামে শিশুদের ঘুম পাড়ানো হয়। বিশেষ করে রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারীর শহীদ আবদুল মান্নান, পঙ্কজ বড়–য়া, জাফর আলম চৌধুরী, বিকাশ বড়–য়া, শামসুল আলম, মুসা খান, শফিকুল আলম, সুবেদার বাদশা মিয়া, সুবেদার নুরুল আমিন, সুবেদার আবুল কাশেম, রুহুল আমিন, সুবেদার আবুল বশর, এজাহার মিয়া, শেখ মোজাফফর আহমদ, হাজি ফজলুল হক সওদাগর, ওমর ফারুক, হরিদয়াল বিশ্বাস, অধ্যক্ষ নতুনচন্দ্র সিংহ প্রমুখের পরিবারে তো সাকা মূর্তিমান আজরাইল হিসেবে এখনও বিরাজ করছেন। সাকার সবচেয়ে বড় রাজাকারী দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ শুরুর একেবারে প্রাথমিক অবস্থাতেই।
সেদিন ছিল ১৯৭১-এর ১৩ এপ্রিল, মঙ্গলবার। ঠিক দুপুর ১২টার সময় ৪ ট্রাক সশস্ত্র পাকিস্তানি সৈন্য ও দুটি জিপ পাকিস্তানি সেনা অফিসার ও একদল রাজাকার নিয়ে সাকা পৌঁছে যান গহিরাস্ত শ্রী কু-েশ্বরী ভবনে। কু-েশ্বরী স্কুল, কলেজ ও ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা দানবীর অধ্যক্ষ শ্রী নতুনচন্দ্র সিংহ ছিলেন অমিত তেজী সিংহপুরুষ। তিনি ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি ও দেশপ্রেমিক। মার্চের শেষ দিকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অন্যদের মতো অধ্যক্ষ নতুন সিংহের পরিবার পরিজনও দেশ ত্যাগ করে ভিনদেশে পাড়ি জমান। কিন্তু অধ্যক্ষ নতুন সিংহ মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন তার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানে। তিনি বলেন, তোমরা যাই-ই বলো আমি আমার মা মাতৃভূমিকে ছেড়ে কোথাও যাব না, সে আমার মৃত্যু হলেও।
সকলে যা আশংকা করেছিল, শেষে তাই হলো। সাকার নেতৃত্বে যমদূত হাজির হয়েছে কু-েশ্বরী কমপ্লেক্সে। সৈন্যরা যখন সেখানে পৌঁছায় অধ্যক্ষ নতুন সিংহ তখন মন্দিরে প্রার্থনায় মগ্ন ছিলেন। সৈন্য দেখে তিনি তাদের সাদরে আহ্বান জানান তার কমপ্লেক্স ঘুরে দেখার। সেনা কমান্ডার বালুচ ক্যাপ্টেন অধ্যক্ষ নতুন বাবুর অমায়িক ব্যবহার ও জনহিতকর এসব প্রতিষ্ঠান দেখে অভিভূত হন এবং ফিরে যেতে প্রস্তুত হন। এ দেখে রাজাকার সাকার মাথা খারাপ। তিনি ক্যাপ্টেনকে বোঝান, এ বুড্ডাকে বাঁচিয়ে রাখলে পাকিস্তানের সমূহ ক্ষতি হবে। এখানে বাঙালি দুষ্কৃতকারীরা এসে আশ্রয় নেবে এবং পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও সম্পদ ধ্বংস করবে। সাকা আরও বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৪৭ জন দুষ্কৃতকারী বাঙালি অধ্যাপককে এই বুড্ডাই আশ্রয়-প্রশ্রয় ও টাকাপয়সা দিয়ে ভারতে পাঠিয়েছে ট্রেনিং-এর জন্য। সুতরাং ও বেঁচে থাকলে সেই দুষ্কৃতকারীরা ভারত থেকে এসে এখানে আবার ঘাঁটি গড়বে। এরপর নতুন বাবুকে মন্দির থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে এনে ক্লোজ রেঞ্জ থেকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা হয়। কিছুদিনের জন্য কু-েশ্বরী মন্দির স্তব্ধ হয়ে যায়।
অধ্যক্ষ নতুন বাবুকে হত্যার পর সাকা বীরদর্পে ওই দিনই গহিরা হিন্দুপাড়ার চিত্তরঞ্জন বিশ্বাসের কলেজ পড়–য়া ছেলে দয়াল হরি বিশ্বাসকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেন। বলাবাহুল্য, গহিরা হলো সাকা রাজাকারের নিজ গ্রাম। সাকার হাতে নিহত বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে আর একজন হলেন বৃহত্তর চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি শেখ মুজাফফর আহমদ।
১৭ এপ্রিল দুপুরের দিকে রাউজানে সত্তরঘাট এলাকা থেকে সাকা বাহিনী শেখ মুজাফফর আহমদকে অপহরণ করে নিয়ে হত্যা করে এবং লাশ গুম করে ফেলে। উল্লেখ্য, সত্তরঘাট হলো রাউজানের উপর দিয়ে প্রবাহিত হালদা নদীর উপর একটি ব্রিজ।
জুন মাসের প্রথম দিকে চট্টগ্রাম শহরে মুক্তিযুদ্ধের কার্যক্রম বিস্তারের পর থেকেই রাউজানের কৈয়াপাড়ার এক অসম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা, ক্যাপ্টেন করিম সুযোগ খুঁজছিলেন রাজাকার সাকাকে খতম করার।
একদিন সেই সুযোগ আসল। ১৪ জুন সোমবার সকালে সিরু বাঙালি নামের এক মুক্তিযোদ্ধাকে ক্যাপ্টেন করিম (পরবর্তীতে তিনি ১৫১ গ্রুপ কমান্ডার) নির্দেশ দিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম ও সাকা চৌধুরীকে অ্যাম্বুশ করে খতম করার জন্য।
টার্গেট শনাক্তকারী হাটহাজারীর একটি ছেলেসহ তাদের চার জনের একটি দল অক্সিজেনের উত্তরে জালালাবাদ রাস্তার মাথায় গিয়ে হাজির হলেন। তারা গেলেন বিভিন্ন দিক থেকে হেঁটে। তাদের অস্ত্রশস্ত্র গেল ১৯৬৮ মডেলের একটি নতুন টয়োটা করোলা মটরের ভেতর লুকিয়ে। অস্ত্রের মধ্যে দুটি ব্রিটিশ টমসন স্টেন গান, ৩৮ ক্যালিবারের দুটি লঙ ব্যারেল ইন্ডিয়ান রিভলবার, ৮টি ৩৬-ই হ্যান্ড গ্রেনেড।
সেদিন তাদের অ্যাম্বুশ কোনো কাজে আসেনি। কারণ তাদের টার্গেট সেদিন নির্দিষ্ট সময়ে ওদিকে আসেনি। কথা ছিল বিকেল ৪টা থেকে ৬টার মধ্যে সাকা রাজাকার তার দোসর হাটহাজারীর লালিয়ার হাটের সৈয়দ ওয়াহিদুল আলমকে নিয়ে ওই দিন শহরের গুড্সহিলে ফিরবে। কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্য, ওরা সেদিন সে সময় ফেরেনি।
এ ঘটনার দুদিন পর ইনফরমেশন নিয়ে আসা সেই ছেলেটির কাছে জানা গেল যে, ওর তথ্য নির্ভুল ছিল। ওদিন ওরা দুজন শহরে ঠিকই ফিরেছিল। তবে তার দেওয়া নির্দিষ্ট সময়ে নয়। ওরা ফিরেছিল দুপুর আড়াইটায়। এরপর সাকাকে মারার জন্য গোপনে বহু চেষ্টা চলেছে। কোনোবারে কেউই সফল হয়নি। শুধু কী এই? ৭১-এ খুনের মামলা করেও এই মহাধুরন্ধর রাজাকারকে কেউ ফাঁসাতে পারেনি। ১৯৭২ সালে দেশ স্বাধীন হবার পরপরই সাকার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনে অধ্যক্ষ শ্রী নতুন সিংহের ছেলে শ্রী প্রফুল্লরঞ্জন সিংহ মামলা দায়ের করেন (মামলা নং ৪১ (১)-৭২ ধারা ৩০২/১২০/১৯৮ দণ্ডবিধি। এই মামলার প্রায় সমসাময়িক কালে এ ধরনের আরও ৩টি হত্যা মামলা রুজু হয় তার বিরুদ্ধে। কিন্তু কোনো মামলাই তার কেশাগ্র স্পর্শ করা যায়নি। কারণ ততদিনে সাকা পগারপার। দেশ স্বাধীন হবার কিছুদিন আগেই পালিয়ে সে বিলাতে চলে যায়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খোন্দকার মোশতাক সরকার তাকে সসম্মানে দেশে ফিরিয়ে আনে।
সাকা রাজাকার অঘটন ঘটনে দারুণ পারদর্শী। তার বিরুদ্ধে আনীত হত্যা, লুণ্ঠন, নারী নির্যাতন ও অপহরণ মামলার সকল নথি মোশতাকের সহায়তায় গায়েব করে নিজের পারদর্র্শিতা এবারও প্রমাণ করলেন সাকা । তারপর থেকে সাকা রাজাকার হলেন সাকা চৌধুরী। অন্ধকার রাজ্যের গডফাদার সাকা চৌধুরী।
এখানে দুটি তথ্য উপস্থাপন করতে হয়। প্রথমত, সাকা রাজাকারের বিরুদ্ধে ১৯৭২-৭৩ সালে দায়েরকৃত অন্তত ৫০টি হত্যা, লুণ্ঠন ও অপহরণ মামলার কার্যবিবরণ রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারীর ও ফটিকছড়ি থানায় হয়তো এখনও মওজুদ থাকতে পারে; কেউ জোর অনুসন্ধান চালালে হয়তো সেসব এখন কাজে লাগতে পারে এবং দ্বিতীয়ত, উপরে উল্লেখিত অভিযোগগুলো সাকার দ্বারা সংঘটিত অপরাধের যৎসামান্য মাত্র। সাকার কুকীর্তির সব কাহিনি তো লিখে শেষ করা যাবে না।