আমার প্রথম মাশরাফি দর্শন

আমার প্রথম মাশরাফি দর্শন

আগে যে মনে হয়নি, তা নয়। হয়েছে। বেশ কয়েকবারই ভেবেছি মাশরাফিকে নিয়ে লিখবো। ভাবছেন সে কি কথা? মাশরাফিকে নিয়ে কতই তো লিখলেন? তাহলে আবার নতুন করে নিয়ে লেখার ইচ্ছে কেন?

আসলে মাশরাফি অনেক বড় ক্রিকেটার। তার চেয়ে বড় অধিনায়ক। নেতা। অভিভাবক, বন্ধু এবং দারুণ অনুপ্রেরণাদায়ী। তার চেয়েও বড়, সত্যিকারের একজন মানুষ। তাকে নিয়ে লেখার কত প্রসঙ্গই তো তৈরি হয়ে আছে।

মাশরাফির টেস্ট অভিষেক, প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে গোড়ালিতে আঘাত পেয়ে মাঠ থেকে ছিটকে পড়া? এসব তো চোখের সামনেই দেখা। সেগুলো নিয়েও প্রচুর লেখালেখি করেছি। এর বাইরে নড়াইল এক্সপ্রেসের ওয়ানডে অভিষেক, জিম্বাবুয়েছাড়া কোন বিশ্বশক্তি, মানে ভারতের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডে বিজয়ের রূপকার মাশরাফির ম্যাচ সেরা পারফরমার হওয়ার গল্পও তো রচিত হয়েছে এই হাত এবং কলম দিয়ে!

তাহলে বাদ থাকলো কোনটা? হ্যাঁ, একটা বিষয় তো আছে। যা নিয়ে লিখবো লিখবো করেও এতদিন লিখা হচ্ছিল না। প্রতিনিয়ত এত কাজের চাপ, এই বয়সেও নিরন্তর সংবাদের পেছনে ছোটাছুটি। তাতে সংশয়ে পড়ে গিয়েছিলাম, সেই লেখাটা আদৌ লিখতে পারবো কি না।

অবশেষে মনের জোর আর ধৈয্য ধরে বসে গেলাম, সেই অজানা বিষয়টি লিখতে। এত বড় ভুমিকা দেখে হয়তো ভাবছেন, কোন মহাকাব্য বুঝি লিখতে বসে গিয়েছি!

Mashrafe Mortaza

আসলে তা নয়। আমি এত কোন ভাল কিংবা বড় লেখক নই যে, লেখনির গুণে কিংবা সাহিত্য মূল্যে পাঠককে মুগ্ধ করে তুলবো। পাঠক এক নিঃশ্বাসে লেখাটা পড়ে শেষ করে ফেলবে। তবে এটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারবো, যা লিখবো তা শুধুই স্মৃতি থেকে নেয়া কথা। হাওয়া থেকে পাওয়া কিংবা কোনো শোনা কথাও নয়। চোখের সামনে যা দেখেছি সেটাই তুলে ধরবো পাঠকের সামনে।

প্রিয় পাঠক, আজ লিখতে বসেছি ‘আমার প্রথম মাশরাফি দর্শন।’ কবে, কীভাবে মাশরাফিকে দেখলাম, পরিচিত হলাম, কেমন দেখলাম, সে সবই তুলে ধরবো।

বলার অপেক্ষা রাখে না, সময়টা ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। আমার মাশরাফিকে প্রথম দেখার কথা বলতে গেলে অলক্ষ্যে চলে আসে কিছু নাম, কয়েকটি চরিত্র এবং একটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। আজ যেমন মিরপুরের শেরে বাংলা স্টেডিয়াম দেশের ক্রিকেটের কেন্দ্রবিন্দু ‘হোম অব ক্রিকেট’। তখনকার সময়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটের মূল ভেন্যু ছিল ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। ঢাকা লিগ, বাংলাদেশের টেস্ট এবং ওয়ানডে অনুষ্ঠিত হতো ওই স্টেডিয়ামেই। বিসিবির অফিসও ছিল বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের দোতলায়।

আমাদের প্রতিদিনকার গন্তব্য ছিল সেখানেই। দিনের একটা বড় সময় কাটতো বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেই। প্রেস বক্স, বিসিবি অফিস রুম, বিশেষ করে দুই ড্রেসিং রুমের মাঝে সিসিডিএম কর্তারা যে ঘরটিতে বসতেন, সেখানেই সাংবাদিক, ক্রিকেট সংগঠক, ক্রিকেটার, প্রশিক্ষকদের আড্ডা জমে উঠতো। পাশাপাশি প্রেসবক্স ঘেঁষে আরও একটি ছোট্ট কক্ষ ছিল। সেখানেও বসে কত দিন, কত ঘণ্টা কাটিয়েছি আমরা। এর বাইরে ইসলামিয়া, আল ইসলাম কিংবা নবান্ন রেস্তোঁরাও ছিল আমাদের প্রতিদিনের বিচরণ ক্ষেত্র।

সেই প্রতিদিনের আড্ডার কোন না কোন সময় ‘মোহাম্মদ আশরাফুলে’র নাম উঠে আসতো। ঠিক উঠে আসা তো বলা সম্ভবত ঠিক হলো না। পরবর্তী সময়ে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে অভিষেকে টেস্ট সেঞ্চুরি করা আশরাফুলকে আমরা ১৯৯৯-২০০০ সাল থেকেই চিনতাম, জানতাম। তাকে দেখেছি তখন থেকে।

এখন যেমন শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের ভিতরে কোণে নেট প্র্যাকটিসের ব্যবস্থা নেই। সব একাডেমি ও ইনডোরে। তখনও তা ছিল না। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের ভিআইপি গ্যালারির সামনে দু’দিকে নেট ছিল। যার একটি ভিআইপি স্ট্যান্ডের বাঁ-দিক ঘেঁষে। অন্যটি তিন নম্বর ভিআইপি গেটের খানিক উত্তর দিক ঘেঁষে। এর বাইরে ঠিক পূর্ব দিকের গ্যালারির ফেন্সিংয়ের সামনেও নেট ছিল। সেখানেই জাতীয় দলের অনুশীলন হতো।

এর বাইরে ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের দলগুলোও কখনো কখনো নিজেদের ঝালিয়ে নিত। এর বাইওে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে প্রায় দিন বিকেলে কয়েকজন কিশোরও প্র্যাকটিস করতে আসতো। আজকের নামী ও প্রতিষ্ঠিত প্রশিক্ষক ওয়াহিদুল গনি ছিলেন তাদের টিচার। আশরাফুল সেই কিশোর ক্রিকেট শিক্ষার্থীদেরই একজন।

আমরা নেটে তার ব্যাটিং দেখতাম আর মুগ্ধ হতাম। আশরাফুল তখন ১৫-১৬ বছরের বালক। অথচ কী চমৎকার সাজানো-গোছানো ব্যাটিং শৈলি ছিল তার! একদম যেটাকে বলে ব্যাকরণ সম্মত ব্যাটিং।

গুড লেন্থ বা ফুল লেন্থ ডেলিভারি সামনের পায়ে আর খাট লেন্থের ডেলিভারি খেলতে গিয়ে কী অবলিলায় পেছনের পায়ে চলে যাওয়া। দেখে খুব ভাল লাগতো। গুড লেন্থ, ফুল লেন্থ আর থ্রি কোয়ার্টার লেন্থের ডেলিভারির বিপক্ষে অবলিলায় শরীর ও বাঁ পা চলে যেত। একদম মাটি কামড়ে নয়ন-মনোহর করা, কপিবুক কভার ড্রাইভ, অফ এবং অন ড্রাইভ।

Mashrafe Mortaza

শর্ট বল পেলেই মুহূর্তের মধ্যে পিছনের পায়ে গিয়ে পুল কিংবা হুক। আবার অফ স্ট্যাম্পের বাইরে একটু খাট লেন্থের বল পেলেই একদম নিপুন স্কোয়ার কাট। এসব দেখতে দেখতে আমি একা নয়, আমাদের সাংবাদিকদের অনেকেই তখন থেকেই আশরাফুল ভক্ত; কিন্তু সে অর্থে মাশরাফিকে চেনা ছিল না কারোরই।

কথাটা হয়ত একটু কানে লাগবে, খানিক দৃষ্টিকটুও মনে হবে। তবে সত্যি কথা হলো, তখন ‘মাশরাফি’ নামে কেউ চেনা ছিল না আমাদের। জানার সুযোগও ছিল না। কারণ, আজকের মাশরাফি নামটাই সেভাবে পরিচিত ছিল না। তখন তাকে সবাই ডাকতেন ‘কৌশিক’ বলে।

আমরা ২০০১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারির আগে সে অর্থে ওই কৌশিককে চিনতাম না। কারণ তখন পর্যন্ত ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের সাথে তার সম্পৃক্ততা হয়নি। এখনকার মত বয়সভিত্তিক জাতীয় পর্যায়ের আসর তখন নিয়মিত হতো না। তাই মাশরাফি সেভাবে আমাদের, মানে মিডিয়ার নজরে পড়েননি।

খুব মনে আছে একদিন পড়ন্ত বিকেলে বিসিবি অফিসের আড্ডায় বন্ধু স্থানীয় কয়েক জনের মুখে প্রথম শুনলাম নামটা; ‘কৌশিক’। নড়াইলের ছেলে। ছয় ফুট লম্বা। স্বাস্থ্য ভাল। এক হারা গড়ন। খুব জোরে নাকি বল করে। নিচের দিকে নেমে ‘ইয়া বড় বড় ছক্কা কাঁকায়।’

১৬ বছর আগের কথা। ঠিক কার মুখে কৌশিক নামটি প্রথম শুনেছিলাম, স্পষ্ট মনে আসছে না। তবে যে আড্ডায় বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা অধিনায়কের নামটি প্রথম শুনি, সেখানে আমাদের ক্রীড়া সাংবাদিক বহরের চেয়ে ক্রিকেট সংগঠক বন্ধুই ছিলেন বেশি।

খুব সম্ভবত বন্ধুবর পাভেল (যার মধ্যস্থতায় মাশরাফি ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে আজাদ স্পোর্টিংয়ের হয়ে প্রথম খেলেছেন), জাহিদ রেজা বাবু (তখন ক্রিকেট সংগঠক এবং এখন দেশের অন্যতম সেরা কিউরেটর। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে প্রধান কিউরেটর) , বাবলা (নবীন সংঘের কর্মকর্তা) আরও কয়েক জন ছিলেন; দুঃখের বিষয়, তাদের নাম মনে আসছে না। তারা সবাই বলাবলি করছিলেন- ‘নড়াইলের একটা ছেলে আছে এবারের বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৭ দলে। প্রচণ্ড গতিতে বল করে। ব্যাটিংটাও পারে বেশ। অনেক বড় বড় ছক্কা মারে।’

খুব জোরে বল করে শুনেই মনের ভিতরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। জানতে চাইলাম কত জোরে? আমাদের প্রিন্স ভাই (জাতীয় দলের সাবেক পেসার গোলাম নওশের প্রিন্স), মাসুদ ভাই (জাতীয় দলের পেসার) ও হাসিবুল হোসেন শান্ত’র (জাতীয় দলের সাবেক পেসার) চেয়েও জোরে বল করে? কে যেন বললেন, কৌশিকের বলের গতি ফর্মের চূড়োয় থাকা প্রিন্স ভাইয়ের চেয়ে কম হবে না। বরং একটু বেশিই হবে।

১৬-১৭ বছরের কিশোর অত জোরে বল করে? শুনেই কেমন যেন ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল মনটা; কিন্তু তাকে কি করে দেখবো? তার মেধা-প্রজ্ঞার দর্শন পাবো কীভাবে? সে তো নড়াইলে থাকে। ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটও খেলে না। আর অনূর্ধ্ব-১৭ দলের ক্যাম্পও তো ঢাকায় হয় না। কে একজন বলে উঠলো, এইতো ক’দিন পরই ঢাকায় এশীয় ক্রিকেটের অনূর্ধ্ব-১৭ আসর বসছে। কৌশিকই ওই দলের এক নম্বর স্ট্রাইক বোলার। লোয়ার অর্ডারের অন্যতম নির্ভরতাও।

যাক দেখা যাবে তাহলে। কাঙ্খিত সময়টা চলে এলো। দেখতে দেখতে এক সময় চলে আসলো আমার প্রথম ‘কৌশিক’ দর্শনের ক্ষণ। দিনটি ছিল ২০০১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। ঠিক চ্যালেঞ্জের সুরে নয়, খুব বিনয়ের সাথে বলে রাখি- শুধু আমিই নই, ওই দিনটির আগে আমাদের মানে বাংলাদেশের ক্রীড়া সাংবাদিকদের যে অংশটা ক্রিকেট নিয়ে বেশি লিখতেন, হয়ত তাদের কারোরই কৌশিককে আগে দেখা হয়নি।

বিকেএসপি মাঠে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৭ দলের সাথে খেলা কুয়েত কিশোর দলের। এখন প্রতিনিয়ত অস্ট্রেলিয়া, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান আর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টাইগারদের খেলা দেখতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা বর্তমান প্রজন্ম নিশ্চয়ই ভাবছেন- কুয়েত আবার ক্রিকেট খেলে নাকি?

এখন খেলে কি না জানি না। তবে তখন খেলতো। আর এশিয়া কাপের আগের এশিয়ায় আইসিসির সহযোগি সদস্য দেশগুলোর সাথেও বয়স ভিত্তিক টুর্নামেন্টসহ এসিসি ট্রফি হতো। এই সুযোগে বলে রাখি, বাংলাদেশ যে আসর জিতে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ছাড়পত্র পেয়েছিল, সেই ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি বিজয়ের কয়েক মাস আগে মালয়েশিয়ায় ‘এসিসি’ ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল টাইগাররা।

কাজেই বাংলাদেশের ক্রিকেটের সাথে প্রতিপক্ষ ৯ টেস্ট খেলুড়ে দেশ, আরব আমিরাত, স্কটল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও আফগানিস্তানের পাশাপাশি মালয়েশিয়া, কুয়েত, জাপানেরও সম্পৃক্ততা ছিল।

আসল কথায় ফিরে যাই। বাংলাদেশ আর কুয়েতের কিশোরদের ম্যাচ দেখতে গেলাম বিকেএসপিতে। ক্রীড়া সাংবাদিক বহরে কয়েজন ছিলাম আমরা। এখনকার মত অত বিশাল বহর ছিল না। সংখ্যায় সাকুল্যে পাঁচ-ছয়জন হয়ত ছিল। সবার নাম মনে নেই। স্মৃতি হাতড়ে দুটি নাম পেলাম। একজন মোস্তফা মামুন। অন্যজন হাসান মাসুদ।

বলার অপেক্ষা রাখে না মোস্তফা মামুন আমাদের প্রজন্মের অন্যতম কুশলী এবং দক্ষ সাংবাদিক প্রতিভা। তখন মোস্তফা মামুনের করমস্থাল ছিল দেশের শীর্ষ দৈনিক প্রথম আলো। মেধা-প্রজ্ঞা আর মননের অনুপম মিশেলে মোস্তফা মামুন এখন দেশবরেণ্য। ক্রীড়া সাংবাদিকতার বাইরেও যার লেখনি সমান ধারালো। বস্তুনিষ্ঠ। জনপ্রিয়। বর্তমানে দৈনিক কালের কন্ঠের ডেপুটি এডিটর।

আর এখন যার প্রধান পরিচয়; অভিনেতা। সেই নামী ও জনপ্রিয় অভিনেতা হাসান মাসুদ তখন সিরিয়াস রিপোর্টার। কাজ করতেন দেশ প্রসিদ্ধ দৈনিক ডেইলি স্টারে। আর আমি ছিলাম দেশ প্রসিদ্ধ দৈনিক জনকণ্ঠে। বলার অপেক্ষা রাখে না আমরা এক সঙ্গেই থাকতাম। খেলা দেখা, আড্ডা, রেষ্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া সবই চলতো একসাথে।

Mashrafe Mortaza

খেলা নিয়ে নানা কথা বার্তা। আলোচনা-পর্যালোচনা ও সমালোচনাও চলতো একসঙ্গে বসেই। যাহোক, খেলা দেখতে বসলাম। বাংলাদেশ আর কুয়েতের খেলা। কি আর দেখবো? আমরা তখন টেস্ট খেলুড়ে দেশ। আর কুয়েত হলো আইসিসির সহযোগি সদস্যের মধ্যে দুর্বলতম দলগুলোর কাতারে। তাদের কিশোরদের সাথে আমরাদের কিশোরদের জয় নিয়ে কোনই সংশয় ছিল না। লক্ষ্য ছিল কে কেমন খেলে?

কয়েকজনের ওপর চোখ থাকলো। প্রথম নামটি অবশ্যই মোহাম্মদ আশরাফুল। তারপর নাফীস ইকবাল। এরপরের নামটিই ‘কৌশিক’। আজকের মাশরাফি বিন মর্তুজা। ওই দিনের ম্যাচে অনূর্ধ্ব-১৭ জাতীয় যুব দলের হয়ে আরও ছিলেন জুনায়েদ সিদ্দিকী, জহুরুল ইসলাম, মোহাম্মদ শরীফ এবং তালহা জুবায়ের।

বলার অপেক্ষা রাখে না, এরা সবাই জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন। অসাধারণ ব্যাটিং প্রতিভার কারণে আশরাফুল নন্দিত। আবার ম্যাচ ফিক্সিংয়ে জড়িয়ে হয়েছেন নিন্দিত, সমালোচিত ও বহিষ্কৃত। এখনও জাতীয় দলে ও বিপিএলে নিষিদ্ধ আশরাফুল।

দেশের এক নম্বর ওপেনার তামিম ইকবালের বড় ভাই বন্দর নগরী চট্টগ্রামের বিখ্যাত ক্রীড়া পরিবার খান বাড়ির নাফীস ইকবাল পুরোপুরি খেলা থেকে অবসর না নিলেও বিপিএলে দু’বছর ম্যানেজারের ভূমিকায়। আর তালহা জুবায়ের এখন খেলা ছেড়ে কোচিংয়ে জড়িত। বিপিএলেও কোচিং করাচ্ছেন। জুনায়েদ ও শরীফ এখনো ক্লাব ক্রিকেট এবং জাতীয় লিগ, বিসিএল নিয়মিত খেলে যাচ্ছেন।

কুয়েতের সাদামাঠা ও দূর্বল বোলিং কী আর মেধাবী ও ওই বয়সেই প্রায় পরিপক্ক আশরাফুলকে টলাতে পারে? পারেনি। আশরাফুল ঠিক সেঞ্চুরি করে ফেললেন। ৯৯ বলে উইকেটের সামনে, দু’দিকে ও পিছনে ১০ বাউন্ডারি হাঁকিয়ে ১০৩ রানের দৃষ্টিনন্দন ইনিংস বেরিয়ে আসলো তার ব্যাট থেকে। নাফিস ইকবাল খেললেন ৩৭ বলে ৩৪ রানের ইনিংস। জুনায়েদ সিদ্দিকীর ব্যাট থেকেও আসলো ৪০ বলে ৩৬ রানের আরও একটি মাঝারী ইনিংস। বাংলাদেশ জিতলো ২১৬ রানের বিরাট ব্যবধানে।

কিন্তু সবার ব্যাটিং ম্লান হয়ে গেলো সেই কৌশিকের উত্তাল উইলোবাজিতে। মাত্র ১৭ বলে ৬০ রানের এক ঝড়ো ইনিংস খেললেন চিত্রা নদীর পাড়ের কিশোর ছেলেটি। যখন ক্রিজে গেলেন, তখন বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৭ দলের রান ২৫৭। বল বাকি ছিল মাত্র ২২টি। আট নম্বরে ক্রিজে যাওয়া কৌশিক একাই প্রায় ৯০ ভাগ স্ট্রাইকে থাকলেন। মাত্র ১৬ মিনিটের একটি ছোট্ট ঝড়। তাতেই লাভ কুয়েতের বোলিং-ফিল্ডিং সব।

বিকেএসপির এক নম্বর মাঠে রান বন্যা। চার-ছক্কার ফুলঝুরি। গুণে গুণে হাফ ডজন ছক্কা হাঁকালেন কৌশিক। আর চারটি বাউন্ডারি। মানে ৫২ রান শুধু ছক্কা ও চার দিয়েই এলো। শেষ ২২ বলে টিম বাংলাদেশ পেলো ৭০ রান।

১৬ বছরের বালক কৌশিকের ব্যাটিং আমরা অবাক চোখে দেখলাম, আর শুধুই মুগ্ধ হলাম। এখনো চোখে ভাসে, তার কিছু শটস। একটু খাট লেন্থে পিচ পড়া ডেলিভারি পেলেই চকিতে পিছনের পায়ে গিয়ে কিংবা সামনের পা শূন্যে তুলে কোমরের জোরে স্কোয়ার লেগ আর মিড উইকেটের মাঝামাঝি জায়গা দিয়ে প্রচণ্ড জোরে পুল। কামানের গোলার মত যা বাতাসে ভেসে গিয়ে আছড়ে পড়ছিল সোজা সীমানার ওপারে।

Mashrafe Mortaza

এখন যেমন উইকেট ছেড়ে দু’পা বেরিয়ে এসে লং অফ-লং অন আর ডিপ মিড উইকেটের ওপর দিয়ে অবলিলায় তুলে মারেন মাশরাফি, সেদিনের কৌশিকের ব্যাট থেকেও তেমন কিছু শট বেরিয়ে এসেছিল। যতবার ‘ডাউন দ্য উইকেটে’ গেলেন, প্রতিবারই হয় চার না হয় ছক্কা হলো।

দৃষ্টি নন্দন ব্যাটিংশৈলি দিয়ে সাজানো শতরান করা আশরাফুল হলেন ম্যাচ সেরা পারফরমার; কিন্তু সে মাখনে ছুরি চালানোর মত ব্যাটিং আর নাফীস ইকবালের ব্যাকরণসম্মত উইলোবাজির কথা বেমালুম ভুলেই গেলাম কৌশিকের ব্যাটিং তাণ্ডব দেখে।

কেন ভুল হবে না? আশরাফুল আর নাফিস যেটা খেললেন, তাতে সৌন্দর্য্য ছিল। ছিল ক্রিকেট ব্যাকরণ মানা এবং শৈল্পিকতার পরশ; কিন্তু কৌশিকের ব্যাট দিল সব ম্লান করে। বিকেএসপির ওপর দিয়ে যেন ১৬ মিনিটের এক টর্নেডো বয়ে গেলো। মিললো এক প্রচণ্ড হার্ড হিটারের দেখা।

এখনকার প্রজন্ম দক্ষিণ আফ্রিকার ডেভিড মিলার, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্র্যাথওয়েট আর ভারতের হারদিক পান্ডিয়ার বিধ্বংসী ব্যাটিং দেখে হন মুগ্ধ। অবাক বিস্ময়ে ভাবেন, কি করে অত বিগ হিট খেলেন তারা? ওইটুকুন বয়সে সেদিনের কিশোর কৌশিকের অবলীলায় বিগ হিট নেবার ক্ষমতা দেখেও আমাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল।

বলতে পারেন ১৬ বছর আগে বিকেএসপি মাঠে একজন জেনুইন হার্ড হিটারের আগমণ ধ্বনি শুনেছিলাম। তার ব্যাটের ছোঁয়ায় বল বিদ্যুৎ গতিতে চলে যাচ্ছিলো সীমানার দিকে। মোস্তফা মামুন আর আমি বারবার বলাবলি করছিলাম- অনেক দিন পর একজন হাত খুলে খেলা উইলোবাজ আসছে।

আমাদের দলে তখন পেস বোলিং অলরাউন্ডার বলতে খালেদ মাহমুদ সুজন। আর মুশফিক বাবুও আসি আসি করছিলেন। তারাও ব্যাটিং ভালোই করতেন। সুজন ছয়-সাত নম্বরে নেমে বেশ বিগ শট খেলতেন; কিন্তু তারপরও ক্রিকেটীয় পরিভাষায় যাকে ‘ক্লিন হিটার’ বলে তার অভাব ছিল।

আমরা আশাবাদী হলাম, এই কৌশিকই হয়ত জাতীয় দলের আগামীর বিগ হিটার। তাকে দিয়েই স্লগে রানের চাকা সচল করা যাবে। পরে বোলিংটাও দেখলাম। ৬ ওভার মোটে বল করলেন কৌশিক। ফিগারটা আহামরি ছিল না; ২৩ রানে এক উইকেট। কুয়েত ওপেনার হামজা আরিফ ক্যাচ দিলেন নাফীস ইকবালের হাতে।

কিন্তু তাতে কী! প্রচণ্ড গতি। তখন তো আর স্পিড মাপার মিটার ছিল না। তবে মনে হয়, ১৪০ কিলোমিটারের আশপাশে বল করলেন। মসৃণ অ্যাকশন। চমৎকার ফলো থ্রু। দু’দিকে সুইং। বল ক্যারিও করলো বেশ। কিছু ডেলিভারি গ্লাভসে নিয়ে হাত ঝাঁকালেন তখনকার উইকেটকিপার বাবেল।

এখনকার মত অত্যাধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া সেন্টার কিংবা কনফারেন্স হলে বসে নয়। আমরা খেলা শেষে কৌশিকের সাথে কথা বললাম, মাঠের ভিতর দাঁড়িয়ে।

১৬ বছরে পদ্মা, মেঘনা-যমুনা আর বুড়িগঙ্গায় অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। আকাশে মেঘ বদলেছে হাজার বার। সেদিনের প্রাণোচ্ছল কৌশিক আজ পরিণত। ৩৪ বছরের। অনেক বড় মাপের ক্রিকেটার। বাংলাদেশের সব সময়ের সেরা অধিনায়ক। বিশাল হৃদয়ের মানুষ। তাই তো আবাল- বৃদ্ধ বণিতা সবাই মাশরাফি বিন মর্তুজার ভক্ত।

এই অসাধারণ ক্রিকেট ব্যক্তিত্বকে প্রথম কাছ থেকে দেখার স্মৃতির কথা ভাবতে মনের অজান্তে একটা অদ্ভুত ভাল লাগায় আচ্ছন্ন হই। নিজেকে অবশ্যই সৌভাগ্যবান মনে হয়। আবার অনুশোচনাও জাগে। বারবার মনে হয়, ইস! এই অসামান্য প্রতিভাবান ক্রিকেটারটির প্রকৃত ও যথাযথ পরিচর্যা হয়নি। হলে হয়তো অকালে এত বড়বড় ইনজুরির ভয়াল থাবা তাকে গ্রাস করতে পারতো না। আর বারবার ইনজুরি ও ছোট-বড় মিলে ১১বার অপারেশন টেবিলে যেতে না হলে আজ যে মাশরাফির দেখা মিলছে, তার চেয়েও অনেক উজ্জ্বল ও সফল পারফরমারের দেখা মিলতো।

Mashrafe Mortaza

নিশ্চয় করে টেস্টে তার উইকেট সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়ে যেতো। ওয়ানডেতেও অন্তত ১০০ উইকেট বেশি থাকতো। আর বারবার ইনজুরি, অস্ত্রোপচার ও রিহ্যাবের পর মাঠে ফেরার সংগ্রামে নিজের বলের গতিও কমতো না। এখনো হয়ত ১৪০ কিলোমিটারের আশপাশে থাকতো তার বলের গতি।

আর সবচেয়ে যেটা মিস করি তা হলো, তার উত্তাল ব্যাটিং। সময় গড়ানোর সাথে সাথে অনেক পেস বোলারের ব্যাটিংয়ে উন্নতি ঘটে; কিন্তু মাশরাফি তা করার সময় ও সুযোগ পেলেন কই? তার ব্যাটে ছিল অমিত সম্ভাবনা।

এখনো মাঝে-মধ্যে জ্বলে ওঠে মাশরাফির ব্যাট; কিন্তু সেটা কালে-ভদ্রে। আমার মনে হয়, ১৬ বছর আগে বিকেএসপিতে যে মাশরাফিকে দেখেছিলাম, আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরুর পরও তার ব্যাট যেমন ছিল। এখন তার অনেকটাই নেই। আজ হারদিক পান্ডিয়া, মিলারদের হার্ড হিটিং দেখে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে আমাদের প্রজন্ম।

আমার স্থির বিশ্বাস, বারবার ইনজুরি মাঠের বাইরে ছিটকে না দিলে আর অস্ত্রোপচার ও রিহ্যাবে জীবনের কিছু মূল্যবান সময় কেটে না গেলে, আমাদের সবার প্রিয় মাশরাফিও তেমন উত্তাল উইলোবাজি করতে পারতেন। সে সামর্থ্য তার ছিল; কিন্তু ওই যে বার বার বলছি, ইনজুরির সাথে নিরন্তর সংগ্রাম করতে করতে ব্যাটিংয়ের দিকে মনোযোগ এবং নজরও দিতে পেরেছেন কম।

‘আমাকে মাঠে ফিরতে হবে এবং সেটা মূলতঃ বোলার হিসেবে’- এই চিন্তা সারাক্ষণ কুরে কুরে খেয়েছে। তাই মাঠে ফেরার তাগিদে অলক্ষ্যে ঢাকা পড়ে গেছে মাশরাফির ব্যাটিং। শুরুতে ক্ষুরধার বোলিংয়ের পাশাপাশি যে উত্তাল ব্যাটিং করতেন অনায়াসে, ইনজুরির ভয়াল গ্রাসে ব্যাটিংয়ের দিকে মনোযোগটাই গিয়েছিল কমে। ইনজুরি মুক্ত মাশরাফি রূপান্তরিত হলেন শুধুই পেস বোলারে। ক্যারিয়ার সায়ান্নে এসে তারও অনুভব, ইনজুরিতে বেশি ক্ষতি গ্রস্ত হয়েছে আমার ব্যাটিং।

তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আজ যিনি আদর্শ অধিনায়কের প্রতিচ্ছবি, গণ মানুষের প্রিয় ক্রিকেটার, ভালো লাগার মানুষ, সেই মাশরাফি বিশ্ব ক্রিকেটে এক সফল অলরাউন্ডারের প্রতিমূর্তি হয়ে উঠতে পারতেন।

খেলাধূলা শীর্ষ খবর