পিলখানায় বিডিআর সদরদপ্তরে (বর্তমান বিজিবি সদরদপ্তর) সংঘটিত বিদ্রোহে নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ১৩৯ জনের মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে রায় দিয়েছে হাইকোর্ট।
বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিশেষ বেঞ্চ সোমবার এ রায় দেয়। বেঞ্চের অপর দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার।
এ মামলায় হাইকোর্ট নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত ১৬০ আসামীর মধ্যে ১৪৬ আসামীর দন্ড বহাল এবং নিম্ন আদালতে খালাসপ্রাপ্ত ৬৯ আসামীর বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের প্রেক্ষিতে ৩১ আসামীকে নতুন করে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয় হাইকোর্ট।
এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের জানান, বিচারিক আদালেতে মৃত্যুদন্ড পাওয়া ১৫২ জনের মধ্যে ১ জন মারা গেছেন। ১৩৯ জনের মৃত্যুদন্ড বহাল রাখা হয়েছে। আর ১২ জনের মধ্যে ৮জনের মৃত্যুদন্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও অন্য চারজনকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে। বিচারিক আদালতের যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত ১৬০ জনের মধ্যে হাইকোর্টের রায়ে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রয়েছে। বাকি ১৪ জনের মধ্যে দু’জন আগেই মারা গেছেন। আর অন্য ১২ জন খালাস পেয়েছেন। বিচারিক আদালতের রায়ে খালাসপ্রাপ্ত ৬৯ জনের সাজা চেয়ে ফৌজদারি আপিল করেছিলেন রাষ্ট্রপক্ষ। তাদের মধ্যে ৩১ জনকে যাবজ্জীবন ও চারজনকে সাত বছর করে কারাদন্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট। আর অন্য ৩৪ জনের খালাসের রায় বহাল রয়েছে।
এটর্নি জেনারেল বলেন, বিচারিক আদালত ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে তিনজন মারা গেছেন। বাকি ২৫৩ জনের মধ্যে ১৮২ জনকে ১০ বছর করে, দুইজনকে ১৩ বছর করে (১০ বছর ও ৩ বছর কারাদন্ড সাজা একসঙ্গে চলবে), ৮ জনকে সাত বছর করে এবং চারজনকে ৩ বছর করে কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। এখান থেকে খালাস পেয়েছেন ২৯ জন। অবশ্য ২৮ জন আপিলই করেননি।
বহুল আলোচিত ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিডিআরের সদর দপ্তরে সংগঠিত বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলায় ১৫২ আসামীর মৃত্যুদন্ডের অনুমোদন (ডেথ রেফারেন্স) ও সাজা বাতিলে আসামীপক্ষের আপিলের ওপর এ রায় দেয়া হয়। একই আদালতে ডেথ রেফারেন্স ও সাজা বাতিলে আসামীপক্ষের আপিলের রায় ছাড়াও দন্ডিতদের সাজা বৃদ্ধি এবং আসামীদের খালাসের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে আনা আপিলেরও রায় দেন।
আসামী সংখ্যার দিক থেকে এটি দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মামলা। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় ওই হত্যাযজ্ঞে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন প্রাণ হারান। এই হত্যা মামলায় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর বিচারিক আদালত রায় দেয়। এ মামলায় আসামী ছিল ৮৪৬ জন। সাজা হয় ৫৬৮ জনের। তাদের মধ্যে বিচারিক আদালতের রায়ে ১৫২ আসামিকে মৃত্যুদন্ড, ১৬০ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড, ২৫৬ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড হয়েছিল। খালাস পেয়েছিলেন ২৭৮ জন।
নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় করা হত্যা মামলায় হাইকোর্টে রায় পড়া গতকাল শুরু হয়ে আজ শেষ হয়। এ রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চিতে পদক্ষেপ নেয়া হয়। নিরাপত্তা জোড়দারে আইন শৃংখলা বাহিনীর বাড়তি ব্যবস্থা নেয়া হয়। পরিচয় পত্র প্রদর্শন ও যৌক্তিক কারণ ব্যতিত সুপ্রিমকোর্ট অঙ্গনে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়।
রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে সংগঠিত হত্যাকান্ডে আনা মামলায় দায়ের করা সকল ডেথ রেফারেন্স ও ফৌজদারি আপিলের ওপর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন গত ১৩ এপ্রিল শেষ হয়। এর আগে বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক পেশ করেন এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
রায়ের পর এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, রায়ে আদালত ৭টি পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। বিজিবির ভাবমূর্তি রক্ষা, এ সদস্যদের বিভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় এবং ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি সংগঠিত নারকীয় ওই ঘটনা বিষয়ে আগাম তথ্য দিতে ব্যর্থতা বিষয় খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। এটর্নি জেনারেল বলেন, সেনাবাহিনীর সম্পূর্ণ নির্দোষ ও গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা কর্মকর্তাদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। তৎকালীন বিডিআর বাহিনীর কিছু সদস্যের উচ্ছৃঙ্খলতা, হিং¯্রতা ও অমানবিকতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যা অকল্পনীয়।
সাজা বিষয়ে কোন আসামীর বিষয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করা হবে কিনা এ বিষয়ে তিনি বলেন, পূর্নাঙ্গ রায় দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে সংগঠিত হত্যাকান্ডে আনা মামলায় দায়ের করা সকল ডেথ রেফারেন্স ও ফৌজদারি আপিলের ওপর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন গত ১৩ এপ্রিল শেষ হয়। এর আগে বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়।
রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি এটর্নি জেনারেল কে এম জাহিদ সরোয়ার কাজল বাসস’কে জানান, মোট একশ ২৪ কার্যদিবসে মামলায় পেপারবুক উপস্থাপন করা হয়। ৩৭০ কার্যদিবস মামলায় শুনানি হয়। তিনি বলেন, নিম্ন আদালতের রায়ের পর মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত এক আসামি মারা গেছেন, ১৪ আসামি এখনো পলাতক রয়েছে।
রাজধানীর পুরান ঢাকার উমেষ দত্ত রোডে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ইতিহাসের কলঙ্কজনক এবং সর্ববৃহৎ এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ১৫২ জনকে মৃত্যুদন্ড, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন, ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে (তিন বছর থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত) কারাদন্ড এবং ২৭৮ জনকে খালাস এবং আর ৪ জন আসামি বিচার চলাকালে মারা যাওয়ায় মামলার দায় থেকে তারা অব্যাহতি পায়। রায়ে খালাসপ্রাপ্ত আসামিদের সাজা চেয়ে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। অন্যদিকে দন্ডপ্রাপ্ত আসামিরা তাদের সাজা বাতিল চেয়ে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। আপিল শুনানির জন্য সুপ্রিমকোর্টের বিশেষ ব্যবস্থায় সর্বমোট ৩৭ হাজার পৃষ্ঠার পেপারবুক প্রস্তুত করা হয়। এজন্য মোট ১২ লাখ ৯৫ হাজার পৃষ্ঠার ৩৫ কপি ও অতিরিক্ত দুই কপি পেপারবুক প্রস্তুত করা হয়। ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তাসহ ৭৪ জন হত্যাকান্ডের শিকার হয়। এ ঘটনায় প্রথমে রাজধানীর লালবাগ থানায় হত্যা এবং বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। পরে এসব মামলা নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তরিত হয়। মামলায় সিআইডি দীর্ঘ তদন্ত শেষে হত্যা মামলায় ২৩ বেসামরিক ব্যক্তিসহ প্রথমে ৮২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে। পরে সম্পূরক অভিযোগপত্রে আরও ২৬ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করায় আসামি দাড়ায় ৮৫০ জনে। এছাড়া বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় ৮০৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় সিআইডি। পরে আরও ২৬ জনকে অভিযুক্ত করে মোট ৮৩৪ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়া হয়। বিচার চলার সময়ে বিডিআরের ডিএডি রহিমসহ চার আসামির মৃত্যু হয়। মামলায় আসামীদের মধ্যে বিএনপি নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু ও স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা তোরাব আলীরও দন্ড হয়েছে। সাজা ভোগকালীন বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
রক্তাক্ত ওই বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী এ বাহিনীর নাম পুনর্গঠন করা হয়। নাম বদলের পর এ বাহিনী এখন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) হিসেবে পরিচিত।