মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তিতে দেশের স্বার্থ অটুট রয়েছে উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী বলেছেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে তিনি সন্তুষ্ট। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের রাজধানীতে চুক্তি স্বাক্ষরের দু’দিন পরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শনিবার তিনি বলেন, ‘চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণœ হবে না… আমাদের স্বাক্ষরিত চুক্তির প্রধান লক্ষ্য বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ফেরত পাঠানো এবং আমরা সেটা করেছি।’
তিনি বলেন, ‘যুক্তিসঙ্গত’ একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে পুনর্বাসন সম্পন্ন হবে যদিও ‘চুক্তি’ স্বাক্ষরের দুই মাসের মধ্যে প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।
মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুকির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীর সঙ্গে বৈঠকের পরে এ দেশটির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ইউ কিয়াও থিন সো’র সঙ্গে এই দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সংকট সমাধানে মিয়ানমারের ওপর প্রবল আন্তর্জাতিক চাপের প্রেক্ষিতে রোহিঙ্গাদের প্রতি জাতিগত নিধনের নির্মমতার অবস্থান থেকে মিয়ানমার সরে আসায় এই চুক্তি স্বাক্ষর হলো।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, গত কয়েক মাস ধরে দুই দেশের কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনা হয়। পরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে ঐক্যমত্যে পৌঁছে এই চুক্তি স্বাক্ষর হয়।
তিনি বলেন, ২২ থেকে ২৩ নভেম্বর দ্বিপাক্ষিক সফরে বাংলাদেশে অণুপ্রবেশকারী জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে আলোচনা এবং একটি দ্বিপাক্ষিক ‘অ্যারেঞ্জমেন্ট’ স্বাক্ষরিত হয়।
মন্ত্রী বলেন, গত মে ২০১৭ থেকে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আলোচনার জন্য মিয়ানমারকে প্রস্তাব দিয়ে এসেছে। গত ২৫ আগস্ট ২০১৭ এর ঘটনার পর মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর নির্মম অভিযানের কারণে লক্ষ লক্ষ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ প্রত্যাবাসন বিষয়ে আলোচনার জন্য সেপ্টেম্বর ২০১৭ এ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলাচালে মিয়ানমারের কাছে পুনরায় প্রস্তাব করে। আমার আমন্ত্রণে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলরের দপ্তরের মন্ত্রী উ চ টিন্ট সোয়ে গত ২ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে বাংলাদেশ সফর করেন এবং প্রত্যাবাসনের ওপর দ্বিপাক্ষিক আলোচনার সূত্রপাত হয়। বাংলাদেশ সম্ভাব্য প্রত্যাবাসন চুক্তির একটি খসড়া হস্তান্তর করে। পরবর্তীতে চুক্তি চূড়ান্ত ও স্বাক্ষর করার জন্য মিয়ানমারের আমন্ত্রণে আমি দ্বিপাক্ষিক সফর শুরু করি।
মাহমুদ আলী বলেন, এ সফরে সম্ভাব্য প্রত্যাবাসন চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে ২২ নভেম্বর পূর্বাহ্নে দু’দেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ আলোচনা করেন। একই দিন অপরাহ্নে আমি এবং স্টেট কাউন্সিলরের দপ্তরের মন্ত্রী খসড়াটি চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে আলোচনা করি। দীর্ঘ আলোচনা শেষে খসড়াটি চূড়ান্ত করি। চুক্তিটি ২৩ নভেম্বর ২০১৭ তারিখ অপরাহ্নে স্বাক্ষরিত হয়।
মন্ত্রী বলেন, স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী মিয়ানমার গত ৯ অক্টোবর এবং ২৫ আগস্ট ২০১৭ এর পরে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী বাস্তুচ্যুত রাখাইন রাজ্যের অধিবাসীদের ফেরত নিবে। এই চুক্তির অধীনে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পর ৯ অক্টোবর ২০১৬ এর আগে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী বাস্তুচ্যুত রাখাইন রাজ্যের অধিবাসীদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। বর্তমান চুক্তি স্বাক্ষরের দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে। এ লক্ষ্যে আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হবে এবং টার্মস অব রেফারেন্স চূড়ান্ত করা হবে। মাঠ পর্যায়ে প্রত্যাবাসন বাস্তবায়নের জন্য দ্রুত ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট ফর রিপ্যাট্রিয়েশন স্বাক্ষরিত হবে। জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ এই চুক্তি বাস্তবায়নে কাজ করবে।
চুক্তিতে বলা হয়, প্রত্যাবসনকারীদের সাবেক আবাসস্থল বা তাদের পছন্দ অনুযায়ী কাছাকাছি কোন স্থানে পুনর্বাসিত করা হবে। প্রাথমিকভাবে তাদের অস্থায়ী আশ্রয়স্থল/ব্যবস্থায় সীমিত সময়ের জন্য রাখা হবে। যৌক্তিক সময়ের মধ্যে প্রত্যাবাসন সম্পন্ন করতে দু’পক্ষ সম্মত হয়েছে।
একটি যাচাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া হবে। এই প্রক্রিয়ায় জটিলতা দেখা দিলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করবে।
দু’পক্ষই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় ইউএনএইচসিআর-এর সহায়তা নিতে সম্মত হয়েছে। মিয়ানমার প্রয়োজন অনুযায়ী উপযুক্ত সময়ে ইউএনএইচসিআর-কে প্রক্রিয়ায় যুক্ত করবে।
চুক্তি অনুযায়ী জাতিসংঘের সংস্থাসমূহ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, এ সফরে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচি’র সাথে আমার বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে শিক্ষা, জ্বালানি, দিপাক্ষিক বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তাছাড়া দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা সম্প্রসারণ এবং আঞ্চলিক যোগাযোগ কাঠামো স্থানে বিসিআইএম প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করার বিষয়ে দু’দেশ একমত পোষণ করেছে।
সফরকালে নাফ নদীর স্থায়ী সীমানা নির্ধারণের ওপর ২০০৭ এ চূড়ান্তকৃত একটি প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়। তাছাড়া, ১৯৯৮ সালে স্বাক্ষরিত নাফ নদীর উত্তরে স্থলভাগের সীমানা নির্ধারণ চুক্তির ‘ইনস্ট্রমেন্ট অব রেটিফিকেশন’ বিনিময় করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক এবং মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।