বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (বিপিএসসি) অধীনে অনুষ্ঠিত চার সহস্রাধিক সিনিয়র স্টাফ নার্স নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে নার্সিং সেক্টরের প্রভাবশালী নয় নার্স নেতার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হওয়ায় রাজধানীসহ সারাদেশের শত শত নার্স নেতাকর্মী হয়রানি আতঙ্কে ভুগছেন।
শাহবাগ থানায় দায়ের করা মামলার আসামিরা কেউ স্বাধীনতা নার্সেস পরিষদ (স্বানাপ) আবার কেউ বাংলাদেশ নার্সিং অ্যাসোসিয়েশন (বিএনএ) ঢাকা মেডিকেল কলেজ শাখার শীর্ষ নেতা।
গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতারকৃত দুই নার্স নেতা আরিফুল ও সাইফুলের দেয়া তথ্যানুসারে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে নার্স নেতা কামাল পাটোয়ারী, মো. ইকবাল হোসেন সবুজ, আনিস, জুয়েল, রফিকুল, ফারুক ও নার্গিস মুন্নীসহ অজ্ঞাত আরও ৫/৬ জনকে আসামি করে মামলা হয়। অবৈধ মাদকদ্রব্য উদ্ধার ও প্রতিরোধ টিম, গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগের (উত্তর) সাব ইন্সপেক্টর মো. তাজুল ইসলাম বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় বৃহস্পতিবার এ মামলা দায়ের করেন।
মামলার এজাহারভুক্ত আসামিদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের নির্দোষ দাবি করে নিছক হয়রানি করতে মামলায় জড়ানো হচ্ছে বলে জোর দাবি করেছেন। নিরপরাধ হয়েও মামলার আসামি হওয়ায় নেতারা তো গা ঢাকা দিয়েছেনই তাদের সঙ্গে সঙ্গে অনুসারী অনেক নার্সও হয়রানির ভয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, মামলার আসামি নার্স নেতারা ক্ষমতাসীন দলের একাধিক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ছাড়াও বিএমএ ও স্বাচিপ নেতাদের কাছে মামলা থেকে রেহাই পাওয়ার পরামর্শ নিতে দৌড়ঝাঁপ করেছেন। বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় বিএমএ ও স্বাচিপ চিকিৎসক নেতারা কেউ সরাসরি পাশে দাঁড়াতে রাজি হচ্ছেন না। তারা সবাই আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করে মামলায় জামিন নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএমএ, স্বাচিপ ও নার্সিং শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার সঙ্গে জড়িত একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা বলছেন, শীর্ষ নার্স নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার ঘটনায় নার্সিং শিক্ষা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। সম্মানহানি হয়েছে নার্সিং সেক্টরের।
তারা জানতে পেরেছেন, কোনো কোনো নার্স নেতা ঘটনার সঙ্গে জড়িত না থাকলেও তাদেরকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করার অপচেষ্টা চলছে। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধী ধরা পড়ুক, চাইলেও নির্দোষ কেউ যেন অযথা হয়রানি না হয়ে সেদিকে লক্ষ্য করে গোয়েন্দা সংস্থাকে কাজ করতে হবে বলে তারা মন্তব্য করেন।
স্বাচিপের একজন শীর্ষ নেতা প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় এখনও পর্যন্ত পিএসসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্রেফতার না হওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, প্রশ্নপত্র তো হেঁটে হেঁটে নার্স নেতাদের কাছে আসেনি। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে পিএসসির কেউ না কেউ জড়িত। তাই অপরাধী নার্স নেতাদের পাশাপাশি প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত পিএসসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্রেফতার করা উচিত বলে মন্তব্য করেন।
সরেজমিনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ একাধিক হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, নার্সদের মধ্যে হয়রানির আতঙ্ক বিরাজ করছে। তাদের অনেকেই বিশ্বাসই করতে পারছেন না শীর্ষ নার্স নেতারা প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত। তবে এজাহারভুক্ত নয় আসামির কমপক্ষে চার-পাঁচজন প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকতে পারেন বলে তারা মনে করেন।
গত ৬ অক্টোবর রাজধানীর ১০টি কেন্দ্রে মোট চার হাজার ছয়শ’ সিনিয়র স্টাফ নার্স (ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি তিন হাজার ছয়শ ও মিডওয়াইফ এক হাজার) নিয়োগ পরীক্ষার বিপরীতে ১৬ হাজার নয়শ’জন অংশগ্রহণ করেন। শিউলি, হাসনাহেনা, রজনীগন্ধা, কামিনী নামে চার সেটের প্রশ্নপত্র ছাপায় পিএসসি। কিন্তু সব সেটের প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পরীক্ষার আগে পাওয়া যায়। একাধিক পরীক্ষার্থী অভিযোগ করেন, পরীক্ষা শুরুর আগে ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন পাওয়া যায়। পরীক্ষার হলে গিয়ে তারা দেখেন, ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
পরীক্ষার পর প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে জানতে পিএসসির চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমে বিষয়টি গুজব বলে উড়িয়ে দেন। পরবর্তীতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রমাণ পেয়ে অনিবার্য কারণে পরীক্ষা বাতিল করে পিএসসি কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনায় পৃথক দুটি তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়।