জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত পাইলট সাব্বিরসহ গ্রেপ্তার চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, তারা উড্ডয়নরত বিমান জিম্মি করে সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের বাসভবনে আঘাত হানার পরিকল্পনা করছিলেন। মিরপুরে জঙ্গি আস্তানায় নিহত আবদুল্লাহর দেয়া ছক অনুযায়ী তারা কাজ করছিলেন।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন এই তথ্য। আজ মঙ্গলবার বিকালে কারওয়ানবাজারের র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
গতকাল সোমবার রাতে বিমান নিয়ে নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগে বাংলাদেশ বিমানের এক পাইলটসহ চারজনকে আটক করে র্যাব। তারা রাজধানীর দারুসসালামে নিহত জঙ্গি আব্দুল্লাহর সহযোগী এবং জেএমবি সদস্য।
আটক পাইলটের নাম সাব্বির। তিনি বাংলাদেশ বিমানের ফার্স্ট অফিসার বলে জানা গেছে।
সংবাদ সম্মেলনে মুফতি মাহমুদ খান জানান, তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিমানের মতো সংবেদনশীল স্থানে সাব্বির চাকরিরত। যেখানে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির যাতায়াত রয়েছে। সেখানে তারা জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে রিক্রুট করার পরিকল্পনা করে।
তিনি আরও জানান, তারা জঙ্গি আবদুল্লাহর তত্ত্বাবধানে কাজ করতেন। গত ২৬ অক্টোবর বিল্লালের কাছ থেকে র্যাব এই তথ্য পেয়ে চারজনকে আটক করেছে। তাদেরকে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আরও তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে আশা করছে সংস্থাটি।
সংবাদ সম্মেলনে মুফতি মাহমুদ খান জানান, গত ২৬ অক্টোবর র্যাব-৪ অভিযান চালিয়ে নারায়ণঞ্জের ফতুল্লা থেকে মিরপুরে নিহত জঙ্গি আবদুল্লাহর অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী জেএমবি সদস্য মো. বিল্লাল হোসেনকে গ্রেপ্তার করে। বিল্লালের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি মতে সোমবার দিবাগত রাত থেকে মঙ্গলবার বেলা ১১টা পর্যন্ত মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এই চারজনকে আটক করে র্যাব।
‘বিমান হামলার টার্গেটে ছিলেন সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিরা’
মুফতি মাহমুদ বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃত সাব্বির এমাম সাব্বিরের মতো একজন দুর্ধর্ষ ব্যক্তি বাংলাদেশ বিমানের মতো সংবেদনশীল স্থানে চাকরিরত, যেখানে সর্বদা বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের যাতায়াত। এ ধরনের একজন উগ্রবাদী জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে র্যাব বাংলাদেশকে নিকট ভবিষ্যতে আরও একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ও ভয়াবহ ঘটনা থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে।’
সংবাদ সম্মেলনে কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, বাংলাদেশ বিমানের ফাস্ট অফিসার গ্রেপ্তারকৃত পাইলট সাব্বির এমাম সাব্বিরের জঙ্গি কার্যক্রমে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তার বাবার নাম হাবিবুল্লাহ বাহার আজাদ। তিনি ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমি থেকে বিমান চালনার প্রশিক্ষণ নেন। এরপর তিনি ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত রিজেন্ট এয়ারওয়েজে চাকরি করেন এবং এ সময় স্পেন থেকে বিশেষ প্রশিক্ষণ নেন।
‘বিমান হামলার টার্গেটে ছিলেন সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিরা’
২০১৪ সালে থেকে আজ পর্যন্ত সাব্বির বাংলাদেশ বিমানের পাইলট হিসেবে কর্মরত। তিনি বাংলাদেশ বিমানের বোয়িং-৭৩৭ পরিচালনা করে থাকেন। তিনি সর্বশেষ গত ৩০ অক্টোবর ঢাকা-কলকাতা-ঢাকা (১৯:৫০-২৩:০০) ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন। গ্রেপ্তারকৃত সাব্বির তুর্কি থেকেও বিমান চালনার ওপর প্রশিক্ষণ নেন। তিনি দুবাই, কাতার, মাসকাট, সিঙ্গাপুর, মালেয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এবং বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ফ্লাইট ছাড়াও অন্যান্য আরও অনেক দেশে বাংলাদেশ বিমানের পাইলট হিসেবে কাজ করেছেন।
র্যাব কর্মকর্তা বলেন, নিহত জঙ্গি আবদুল্লাহর সঙ্গে পাইলট সাব্বিরের ঘনিষ্ঠতা ছিল এবং তিনি মানিক ওরফে ফরহাদ ওরফে সারোয়ার জাহানের কাছ থেকে বায়াত গ্রহণ করেন। গুলশান হামলার আগে ও পরে আবদুল্লাহ, গ্রেপ্তারকৃত পাইলট সাব্বির, সারোয়ার একত্রে নাশকতার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গ্রেপ্তারকৃত পাইলট সাব্বির বিমান চালিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের বাসভবনে আঘাত করা অথবা বিমানের যাত্রীদের জিম্মি করে মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আলোচনা করেন। তার চাকরি ভাতা বাবদ ১০ লাখ টাকা পাওয়ার কথা ছিল এবং ওই টাকাগুলো পেলেই আবদুল্লাহর মাধ্যমে সংগঠনে দান করবেন বলে আবদুল্লাহকে কথা দিয়েছিলেন।
‘বিমান হামলার টার্গেটে ছিলেন সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিরা’
র্যাব কর্মকর্তা বলেন, গ্রেপ্তারকৃত সুলতানা পারভীনের স্বামী হাবিবুল্লাহ বাহার আজাদ। তার গ্রামের ঝিনাইদহের শৈলকুপা থানার বিত্তিপাড়া গ্রামে। তিনি রাজধানীর দারুসসালাম থানার ২/৩ বি, বর্ধণবাড়ির মালিকের স্ত্রী। নিহত জঙ্গি আবদুল্লাহ তার বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। তিনি আবদুল্লাহর ভাড়াকৃত ফ্ল্যাটে গিয়ে এবং ছাদে উঠে প্রায় সমেই জঙ্গি সংগঠনের বিষয়ে আলোচনা করতেন। তিনি আবদুল্লাহর বাসায় মানিক ওরফে ফরহাদ ওরফে সারোয়ার জাহানের কাছে বায়াত গ্রহণ করেন। এছাড়াও তিনি সংগঠনের জন্য বিভিন্ন সময় আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন।
র্যাব জানায়, গ্রেপ্তারকৃত মো. আসিফুর রহমান আসিফের বাবার নাম মো. আলমগীর হোসেন, তার গ্রামের বাড়ি যশোরের সদর থানার ছোট শেখহাটি মাস্টারবাড়ী গ্রামে। তিনি গ্রেপ্তারকৃত সুলতানা পারভীনের ভাইয়ের ছেলে। নিহত আবদুল্লাহ সাথে আসিফের ঘনিষ্ঠতা ছিল বিধায়, প্রায় সময়ই তিনি আবদুল্লাহর বাসায় যাতায়াত করতেন এবং জঙ্গি সংগঠনের বিভিন্ন বিষয়ে তারা আলোচনা করতেন। তিনিও মানিক ওরফে ফরহাদ ওরফে সারোয়ার জাহানের কাছে বায়াত গ্রহণ করেন। তিনি বিস্ফোরক তৈরির জন্য আবদুল্লাহর বাসায় বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল সরবরাহ করতেন। এছাড়াও তিনি তার বন্ধুর কাছ থেকে একটি ৯ এমএম পিস্তল এনে আবদুল্লাহকে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দাম বেশি হওয়ায় আবদুল্লাহ পিস্তলটি নেননি। সুলতানা পারভীন ওই অস্ত্রটি কেনার জন্য আবদুল্লাহকে টাকা দিতে সম্মত হয়েছিলেন।
গ্রেপ্তারকৃত মো. আলমের বাবার নাম মঞ্জু মিয়া। তার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার কেন্দুয়া থানার উজ্জ্বলপুর গ্রামে। তিনি ঢাকায় দারুসসালাম থানার ভাঙাদেয়ালের ২/১ নম্বর বাসায় থাকতেন। তিনি একজন চায়ের দোকানদার। তিনি বিভিন্ন সময় সংগঠনের কাজে আবদুল্লাহকে গাড়ি সরবরাহ করতেন। গত রমজান মাসের আগে গ্রেপ্তারকৃত আলমের মাধ্যমে ট্রাক সংগ্রহ করে সেই ট্রাক চালিয়ে তাদের নিকটবর্তী পুলিশি স্থাপনায় নাশকতার পরিকল্পনা করেন আবদুল্লাহ। সম্প্রতি ইউরোপে জঙ্গিদের গাড়ি হামলা কৌশলে অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রেপ্তারকৃত আলমের সরবরাহকৃত গাড়ি দিয়ে সংগঠনের অন্যান্য সদস্যরা গাড়ি চালানোর অনুশীলন করে। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও জার্মানির মতো এদেশে তাদের উদ্দেশ্য ছিল গাড়ি চালানো শিখে বিভিন্ন স্থানে গাড়ি অথবা গাড়িবোমা হামলা করা।