বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এবং ওই সময়ের প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদ, ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা ও সার্বিক সহযোগিতায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ভয়াবহ হত্যাকান্ড ঘটানো হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি সিনিয়র এডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান আজ চতুর্থ দিনের মতো যুক্ততর্ক শুনানিতে এ বক্তব্য তুলে ধরেন। রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক পেশ অসমাপ্ত অবস্থায় মামলার কার্যক্রম কাল মঙ্গলবার পর্যন্ত মূলতবি করা হয়েছে। রাজধানীর পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিনের আদালতে এ মামলার বিচার চলছে।
রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি যুক্তি উপস্থাপনে আরো বলেন, ঘটনায় জড়িত অন্যতম আসামি জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নান, জঙ্গি বিপুলকে অন্য একটি মামলায় আটকের পর এবং ২১ আগষ্ট মামলায় তার সম্পৃক্তার বিষয়ে জবানবন্দি থাকার পরও এ মামলায় প্রথমাবস্থায় আটক না দেখোনোর সঙ্গে জড়িতদের অপরাধ বিষয়ে যুক্তি পেশ করেন সৈয়দ রেজাউর রহমান। মুফতি হান্নান তার জবানবন্দিতে সরকার ও প্রশাসনের সহযোগিতা পাওয়ার কথা বলেছেন।
সৈয়দ রেজাউর বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এবং ওই সময়ের প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদ, ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা ও সার্বিক সহযোগিতায় ঘটনায় জড়িতদের আড়াল করে তাদের বাঁচাতে জজ মিয়ার মতো নিরীহ লোকদের ফাঁসিয়ে মামলা ও ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। মামলার এজাহার, কয়েক দফা তদন্ত এবং আদালতে সাক্ষীদের সাক্ষ্যের সূত্র ধরে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি আসামীদের অপরাধের বিষয়ে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার লক্ষেই ওই হামলা চালানো হয়। এতে প্রাক্তন (প্রয়াত) রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিনী আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ বহু নেতাকর্মী, আইনজীবী-সাংবাদিক সাধারণ মানুষের হতাহতের ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনা ঘটাতে গ্রেনেট সরবরাহ, ঘটনাস্থল থেকে আসামিদের নির্বিঘেœ পালাতে সুযোগ করে দেয়া, ঘটনার অন্যতম আসামি মাওলানা তাজউদ্দিন (আসামি বিএনপি নেতা সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর ভাই)কে বাদল নামে বিদেশে পালাতে সহযোগিতা করার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নামোল্লেখ করে তাদের অপরাধ বিষয়ে যুক্তি পেশ করা হয়।
গ্রেনেড হামলার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে বিএনপির দুই নেতা তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্য ও যুক্তি পেশ করেন প্রধান কৌঁসুলি। তিনি বলেন, পুলিশের তৎকালীন উপ-কমিশনার ডিসি (দক্ষিণ) খান সাঈদ হাসান ঘটনাস্থলে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহন করেননি। তৎকালীন ডিসি (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান ঘটনায় জড়িত আসামিদের গ্রেনেড আক্রমণের সুবিধায় ও রক্ষার উদ্দেশ্যে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেননি। এ ঘটনায় ব্যবহৃত অবিস্ফোরিত তাজা গ্রেনেড আলামত হিসেবে জব্দ করার পরও তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেননি। এ মামলার আসামি মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন, লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, সাবেক আইজিপি খোদা বক্স চৌধুরী এবং তিন তদন্ত কর্মকর্তা সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সিআইডির সিনিয়র এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান, এএসপি আব্দুর রশীদের অপরাধ বিষয়ে যুক্তি পেশ করেন। এ আসামিরা ঘটনা সংগঠিত করা ও অপরাধীদের আড়াল করতে কিভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন তার যুক্তি পেশ করেন সৈয়দ রেজাউর রহমান।
প্রধান কৌঁসুলিকে যুক্তিতর্ক পেশে আরো সহায়তা করেন আইনজীবী আকরাম উদ্দিন শ্যামল, ফারহানা রেজা, আমিনুর রহমান। অপরদিকে আসামিপক্ষে আইনজীবী নজরুল ইসলাম, আব্দুল সোবহান তরফদার আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
নৃশংস, চাঞ্চল্যকর ও ভয়াবহ ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় গত ২৩ অক্টোবর থেকে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক শুরু হয়েছে। স্পর্শকাতর ও আলোচিত এ মামলায় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) সিআইডির জ্যেষ্ঠ বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দসহ ২২৫ জনের সাক্ষ্য দিয়েছেন। এরপর আসামীদের আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য পেশ ও আসামীপক্ষ সাফাই সাক্ষ্য নেয়া হয়।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা থেকে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের প্রথম সারির অন্যান্য নেতৃবৃন্দ প্রাণে বেঁচে যান। এতে অল্পের জন্য শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও গ্রেনেডের প্রচন্ড শব্দে তার শ্রবণনেন্দ্রীয় আঘাতপ্রাপ্ত হয়।
এ ঘটনায় পরদিন মতিঝিল থানার তৎকালীন এসআই ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। মামলাটি প্রথমে তদন্ত করে থানা পুলিশ। পুলিশের তদন্তের পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তদন্তের দায়িত্ব পায়। পরে মামলাটি যায় সিআইডিতে। ২০০৮ সালের ১১ জুন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির জ্যেষ্ঠ এএসপি ফজলুল কবির জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়। ২০০৯ সালের ৩ অগাস্ট রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটির অধিকতর তদন্তের আবেদন করলে ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করে। মামলাটি তদন্তের ভার পান সিআইডির পুলিশ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ। তিনি ২০১১ সালের ৩ জুলাই বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ৩০ জনের নাম যুক্ত করে মোট ৫২ জনের নামে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি অভিযোগপত্র দেন।
আদালত সূত্র জানায়, চার্জশিটে অভিযুক্ত ৫২ জনের মধ্যে ১৯ জন পলাতক, ৮ জন জামিনে রয়েছে এবং বাকিরা বিভিন্ন কারাগারে রয়েছে। অভিযুক্ত আসামীদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামীর প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় ফাঁসি হয়। মামলার আরেক আসামি মুফতি হান্নানের ফাঁসি হয়েছে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর উপর গ্রেনেড হামলার মামলায়।
মামলার আসামী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপি নেতা সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু কারাগারে রয়েছে। এ মামলায় পুলিশের সাবেক আইজি আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদাবক্স চৌধুরী এবং সাবেক তিন তদন্ত কর্মকর্তা- সিআইডি’র সাবেক এসপি রুহুল আমিন, সিআইডি’র সাবেক এএসপি আতিকুর রহমান ও আবদুর রশিদ জামিনে রয়েছে।