আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে নিরাপত্তা পরিষদের সমর্থন

আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে নিরাপত্তা পরিষদের সমর্থন

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার পূর্ণ বাস্তবায়নে সমর্থন দিয়েছেন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।

শুক্রবার জাতিসংঘ সদর দফতরের ইকোসক চেম্বারে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে অনুষ্ঠিত আরিয়া ফর্মুলা সভায় এই সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়।

ব্রিটিশ ও ফরাসী ডেলিগেশন এই সভার আয়োজন করে। এ্যাডভাইজরি কমিটি অন রাখাইন স্টেটের চেয়ারম্যান নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান এ সভায় বক্তব্য রাখেন।

কফি আনান তার বক্তব্যে সম্প্রতি মিয়ানমার সরকারের কাছে পেশকৃত ‘এ্যাডভাইজরি কমিটি অন রাখাইন স্টেট’ এর রিপোর্টের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোকপাত করেন। রাখাইন প্রদেশের জনগণের স্থায়ী শান্তি, নিরাপত্তা, সমৃদ্ধি, উন্নয়ন ও চলমান সংকটের সমাধানের লক্ষ্যে মিয়ানমার সরকার তার কমিশন প্রণীত প্রতিবেদনের সুপারিশমালার বাস্তবায়ন করবে মর্মে তিনি প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। কফি আনান রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের ১৯৮২ সালে প্রণীত নাগরিকত্ব আইন আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সংশোধনের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেন। রোহিঙ্গাদের মর্যাদা ও নিরাপত্তার সঙ্গে নিজ ভূমিতে প্রত্যাবর্তন, মানবিক সহায়তা ও মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করতে কফি আনান তার রিপোর্টে উল্লেখ করেন।

তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত নিরাপত্তা ও দ্বিপাক্ষিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা রক্ষা করার বিষয়ে জোর দিয়ে বলেন, এই সুসম্পর্ক ও সহযোগিতার মাধ্যমে উভয় দেশই লাভবান হবে। কফি আনান রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে মিয়ানমারের আন্তঃসম্প্রদায়ের মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতার উপর বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেন।

কফি আনান বলেন, এই ভয়াবহ রোহিঙ্গা সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত রাখাইন প্রদেশের জনগণের কল্যাণে মিয়ানমার সরকার রাখাইন জনগোষ্ঠী ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ঐক্যমত্য হয়ে কাজ না করে।

নিরাপত্তা পরিষদের সকল সদস্যই এ সংকট সমাধানের পক্ষে বক্তব্য রাখেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি এটিকে মানবিক বিপর্যয় আখ্যা দিয়ে বলেন, এনাফ ইজ এনাফ। আমরা এটি আর গ্রহণ করতে পারছি না। আমরা মিয়ানমার সিকিউরিটি ফোর্সের এই হীন কাজের নিন্দা জানাই।

যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি অনতিবিলম্বে মানবিক সহযোগিতা প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি, সহিংসতা বন্ধ, জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের পূর্ণ প্রবেশাধিকার, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদ ও নিশ্চয়তার সঙ্গে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনসহ কফি আনান কমিশনের রিপোর্টের পূর্ণ বাস্তবায়নের উপর জোর দেন। প্রায় একই ভাষায় কথা বলে নিরাপত্তা পরিষদের অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা। তারা অসহায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মানবিক সাহায্য প্রদান করায় বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশের জনগণের ভূয়সী প্রসংশা করেন। সকলেই সহিংসতা বন্ধ, কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালা বাস্তবায়নের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

un

নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের বাইরে বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড এর প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন। এ ছাড়া অফিস অব দ্যা হাই কমিশন অব হিউম্যান রাইটস, অফিস ফর দ্যা কো-অর্ডিনেশন অব হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্স, ইউএনএইচসিআর এর প্রতিনিধি, ওআইসি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন।

জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন বলেন, মিয়ানমার সরকারের দেয়া বিবৃতি আর রাখাইন প্রদেশের প্রকৃত পরিস্থিতির মধ্যে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের অফিসের র্যাপিড রেসপন্স মিশনের সাম্প্রতিক রিপোর্টে এমনটিই তুলে ধরা হয়েছে। ২৫ আগস্টের পর থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ৫ লাখ ৩৬ হাজার মানুষ মিয়ানমার সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সব মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ লাখে।

গত মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রদত্ত ভাষণে মিয়ানমার পরিস্থিতির সমাধানে যে ৫টি পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করা হয় রাষ্ট্রদূত তার বক্তৃতায় তা তুলে ধরে বলেন, সহিংসতা ও একটি জাতিকে নির্মূলের প্রক্রিয়া বন্ধ, মিয়ানমারে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফান্ডিং মিশন প্রেরণ, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সেফ জোন তৈরি, জোরপূর্বক উচ্ছেদকৃত মানুষদের নিজ ভূমিতে স্থায়ী প্রত্যাবর্তন এবং কফি আনান কমিশনের সুপারিশের পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।

রাষ্ট্রদূত মোমেন আরও বলেন, মিয়ানমারের সামরিক জান্তার উপর্যুপরি উস্কানি এবং বাংলাদেশের আকাশ সীমা লঙ্ঘন সত্ত্বেও বাংলাদেশ সর্বোচ্চ সহিষ্ণুতা প্রদর্শন ও মিয়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে।

উল্লেখ্য, গত ২৮ আগস্ট থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমার পরিস্থিতির উপর তিন বার আলোচনায় বসে। ১৩ সেপ্টেম্বর নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। নিরাপত্তা পরিষদ এই সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানায় এবং মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনী দ্বারা সৃষ্ট রাখাইন প্রদেশের সাধারণ জনগণের উপর উপর্যুপরি এই সহিংসতা বন্ধ, রাখাইন প্রদেশে আগের অবস্থা ফিরিয়ে আনা, আইন-শৃঙ্খলার পুনঃস্থাপন, সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা, স্বাভাবিক আর্থ-সামাজিক পরিবেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানায়।

অন্যান্য বাংলাদেশ