রাজধানীর বেগুনবাড়ি-হাতিরঝিল প্রকল্পের খালের ওপর নির্মিত বহুতল বিজিএমইএ ভবন আদালতের বেঁধে দেওয়া শেষ সময়ের মধ্যে ভাঙা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। রোববার হাতিরঝিলের বিষফোঁড়া খ্যাত বিজিএমইএ ভবনকে ভাঙতে সাত মাস সময় দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। তবে বিজিএমইএ বলছে, ওই সময়ের মধ্যে ভবন স্থানান্তর সম্ভব কি না বলা যাচ্ছে না।
কিন্তু বিজিএমইএর কাছে সময় আছে মাত্র ৬ মাস। কেননা আপিল বিভাগের বেঁধে দেওয়া ৭ মাসের সময়সীমা গণনা শুরু হবে গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে। ওইদিন গণনা শুরুর কারণ হলো ওই ভবন ভাঙা সংক্রান্ত আদেশের রায় শেষ হয়েছে ১২ সেপ্টেম্বর। তবে মাত্র ৬ মাসেই এ ভবন সরানো সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
ভবন স্থানান্তরে এরইমধ্যে রাজধানীর উত্তরার ১৭ নম্বরে জমি পেয়েছে বিজিএমইএ। কিন্তু এখনো ওই জায়গায় ভবনের নকশা তৈরি এবং ভবনের নকশার অনুমোদন পায়নি। ফলে বিজিএমইএ তাদের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে নতুন ভবন চালুর বিকল্প নেই। নতুন ভবন নির্মাণের আগে বিজিএমইএ ভবন ভাঙা হলে তা পোশাক রফতানিখাতে প্রভাব ফেলবে বলে জানানো হয়েছে।
বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, উত্তরার বরাদ্দ পাওয়া জায়গার দলিল আমরা হতে পেয়েছি। নকশা তৈরিতে কনসালটেন্ট নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নকশা তৈরি হলে আমরা রাজউকের অনুমোদনের জন্য কাগজপত্র দাখিল করব। এরপর নতুন ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই সময় স্থানান্তর সম্ভব কিনা সেটা এখনি বলা যাবে না। আগামী ৪-৫ মাসে নতুন ভবনের কাজ কতটুকু অগ্রগতি হয়, তার ওপর নির্ভর করবে।
‘আমরা এখান থেকে চলে যাব এটা নিশ্চিত’ মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, তবে নতুন ভবন নির্মাণের আগে বর্তমান ভবন ভাঙা হলে রফতানিখাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বিজিএমইএ- কর্তৃপক্ষের করা সময় আবেদন মঞ্জুর করে রোববার ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ সময় মঞ্জুর করে আদেশ দেন।
আদালতে বেঁধে দেওয়া সময় গত ১২ সেপ্টেম্বর শেষ হওয়ার পর ভবন অপসারণে আবারও একবছর সময় চেয়ে আবেদন করা হয়। বিজিএমইএ’র পক্ষে করা ওই আবেদনের ওপর শুনানি শেষে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ শেষবারের মতো সাত মাস সময় দেন।
এর আগের আদেশে ছয়মাসের মধ্যে ভবন অপসারণের নির্দেশ দেওয়া হয়। আপিল বিভাগের বেঁধে দেওয়া এ সময় শেষ হয়েছে গত ১২ সেপ্টেম্বর। কিন্তু এ সময় শেষ হওয়ার আগেই আদালতে বিজিএমইএ’র পক্ষে আরো একবছর সময় চেয়ে গত ২৩ আগস্ট আবেদন করা হয়। আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি গত ১১ সেপ্টেম্বর এক আদেশে ৫ অক্টোবর এ আবেদনের ওপর শুনানির দিন ধার্য করেন। এছাড়া ভবন অপসারণের সময় এ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেন।
আদালতে বিজিএইএ’র পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট কামরুল হক সিদ্দিকী ও ব্যারিস্টার ইমতিয়াজ মইনুল ইসলাম। রাজউকের পক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। আদালতে বন্ধু (অ্যামিকাস কিউরি) হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ।
শুনানির শুরুতে বিজিএমইএ’র আইনজীবী অ্যাডভোকেট কামরুল হক সিদ্দিকী আদালতকে বলেন, রাজউক বিজিএমইএ-কে উত্তরায় জমি দিয়েছে। জমির টাকাও পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু অবকাঠামো নির্মাণ হয়নি। এ কারণে ভবন অপসারণে একবছর সময় দরকার।
এ সময় আদালত তার কাছে আপিল বিভাগের রায় ও রিভিউ খারিজের তারিখ জানতে চান। কিন্তু বিজিএমইএ’র আইনজীবী উত্তর না দিয়ে চুপ থাকেন। এ সময় আদালত বলেন, আপনি কবে অবকাঠামো নির্মাণ করবেন, ততদিন পর্যন্ত কি আদালত চুপ করে বসে থাকবে?
আদালত বলেন, আদালতের রায় ছিল, বিজিএমইএ ভবন না ভাঙলে সেটা রাজউক ভাঙবে। এ সময় আদালত রাজউকের আইনজীবীর বক্তব্য জানতে চান। রাজউক কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা জানতে চান।
রাজউকের আইনজীবী অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, রাজউক প্রস্তুত রয়েছে। তবে বিজিএমইএ’র আবেদন আদালতে বিচারাধীন থাকায় কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
এ সময় আদালত বলেন, আদালতে সময়ের আবেদন করা হবে আর আদালত সময় দেবে-এ মানসিকতা ঠিক না। রাজউক কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা জানান। এ কথা বলে আদালত বেলা সাড়ে ১১টায় আদেশের সময় নির্ধারণ করেন। নির্ধারিত সময়ে আদালত সাত মাস সময় দিয়ে আদেশ দেন। আদালত বলেন, এটাই শেষ সময়। আর সময় দেওয়া হবে না। মক্কেলকে বলবেন, এ সময়ের মধ্যে ভবন অপসারণ করতে। আদালতের আদেশের প্রতি সম্মান রাখবেন।
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) ভবন নির্মাণ করা নিয়ে ২০১০ সালের ২ অক্টোবর ইংরেজি দৈনিক ‘নিউ এজ’ পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনটি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ডিএইচএম মনির উদ্দিন আদালতে উপস্থাপন করেন। পরদিন হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে (সুয়োমোটো) রুল জারি করেন।
এ রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে ওই ভবনটিকে ‘হাতিরঝিল প্রকল্পে একটি ক্যান্সারের মতো’ উল্লেখ করে তা রায় প্রকাশের ৯০ দিনের মধ্যে ভেঙে ফেলতে রাজউককে নির্দেশ দেওয়া হয়। ভবন ভাঙার খরচ বিজিএমইএ’র কাছ থেকে আদায় করতে বলা হয়। এছাড়া যাদের কাছে ফ্লাট বিক্রি করা হয়েছে তাদের টাকা (লভ্যাংশ ছাড়া) ফেরত দিতে বলা হয়।
২০১৩ সালের ১৯ মার্চ হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এরপর বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে আপিল করার অনুমতি চেয়ে (লিভ টু আপিল) আপিল বিভাগে আবেদন করা হয়। এ আবেদন গতবছর ২ জুন খারিজ করেন আপিল বিভাগ। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় গতবছর ৮ নভেম্বর প্রকাশিত হয়।
এ রায়ের কপি পাওয়ার পর গতবছর ৮ ডিসেম্বর বিজিএমইএ রিভিউ আবেদন দাখিল করে। ৫ মার্চ এ রিভিউ আবেদন খারিজ করেন আপিল বিভাগ। এরপর বিজিএমইএ ভবন সরাতে তিনবছর সময় চেয়ে আবেদন করে। এ আবেদন নিষ্পত্তি করে আপিল বিভাগ ৬ মাস সময় দিয়েছিলেন।