দিনাজপুরের ১৩ উপজেলার মধ্যে বীরগঞ্জ ও কাহারোল পাশাপাশি দুটি উপজেলা। এ দুই উপজেলা থেকে এবার প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে অনেকেই। তবে এদের মধ্যে ৫ জন রয়েছে হতদরিদ্র শিক্ষার্থী। তাদের সাফল্যে এলাকায় আনন্দের বন্যা বয়ে গেলেও পরিবারের মাথায় একটাই চিন্তা। আর সেটা হচ্ছে অর্থ। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বাবদ যে অর্থের দরকার তা জোগাড় করা এদের পরিবারের পক্ষে সম্ভব না। তাই মেধাবী এ শিক্ষার্থীরা তাকিয়ে আছে বিত্তবান ব্যক্তি, সংগঠন কিংবা সরকারের সহযোগিতার দিকে।
রুনা আক্তার বীরগঞ্জের ঝাড়বাড়ি প্রসাদ পাড়া বাজার এলাকার নুর ইসলাম ও রহিতন বেগমের মেয়ে। এবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘খ’ ইউনিটে পরীক্ষা দিয়ে ১৭৫৪তম স্থান পেয়েছে।
গ্রামের আর দশ জন মেয়ের মতো স্বাভাবিক জীবন ছিল না রুনার। প্রতিনিয়ত সংগ্রাম আর অনটনের মধ্যে তার বেড়ে ওঠা। দুই বেলা দু’মুঠো খেতে পারাটাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। সেই প্রতিকূল অবস্থায় পড়ালেখা করেই আজ সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
রুনার বাবা নুর ইসলাম পেশায় একজন চা বিক্রেতা। ছেলে সন্তান না থাকায় মেয়ে রুনাই দোকানের বিভিন্ন কাজে বাবাকে সাহায্য করত। ভবিষ্যৎ স্বপ্ন বা ইচ্ছার কথা জানতে চাইলে রুনা জানায়, বিসিএস ক্যাডার হয়ে দেশের সেবা করতে চায় সে।
একইভাবে বীরগঞ্জ উপজেলার শতগ্রাম ইউনিয়নের পালপাড়া গ্রামের লেবু পাল ও শ্রীমতি পালের ছেলে উদ্ভব পাল। এসএসসি কিংবা এইচএসসি কোনোটিতেই জিপিএ-৫ নেই। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে পড়তেই হবে। এটা তার স্বপ্ন নয় বিশ্বাস। অবশেষে ‘খ’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ২১১৩তম স্থান নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে উদ্ভব।
পেশায় কুমার বাবার পক্ষে মাটির হাড়ি-পাতিল বিক্রি করে ছেলের ভর্তি ফিস জমা করা সম্ভব না। তাই সকলের সাহায্য কামনা করেন উদ্ভবের মা শ্রীমতি পাল।
বীরগঞ্জের আরেক মেধাবী মো. সুমন ইসলাম ‘খ’ ইউনিট থেকে ২২৪৩তম স্থান নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। সে পাল্টাপুর ইউনিয়নের সাদুল্ল্যাহ পাড়ার মো. বজলুর রহমান ও রহেদা বেগমের ছেলে।
সংসারে বাবা থাকতেও নেই। পরিবারের সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে। মা রহেদা বেগম চাতাল শ্রমিক। মাকে সহযোগিতা করতে ও নিজের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য মাঝে মাঝে স্কুল-কলেজ না গিয়ে তাকে কৃষি শ্রমিকের কাজ করতে হয়। মা আর চার ভাই বোন নিয়ে তাদের সংসার অভাব অনটন লেগেই থাকে। যেখানে সংসার চলাই দায় সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার চিন্তা তাদের কাছে আকাশ কুসুম। তারা এখন চেয়ে আছেন সমাজের বিত্তবান ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দিকে।কারো সহযোগীতা না পেলে সুমনের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।
একই ইউনিয়নের ঘোড়াবান্দ গ্রামের বাসিন্দা মো. হাছিনুর রহমান। ভ্যানচালক সমাজ উদ্দীন ও গৃহিনী হাছিনা বেগমের ছেলে হাসিনুর এবার ‘খ’ ইউনিট থেকে ৭৪৮তম স্থান নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। বাবা অসুস্থ হওয়ার কারণে এখন ভ্যান চালাতে পারেন না। হাছিনুরই মানুষের বাড়িতে কামলার কাজ করে খেয়ে পরে বেঁচে আছে।
পরীক্ষার জন্য যাবতীয় খরচও দিয়েছেন এক প্রতিবেশী। এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে শিক্ষা জীবন চালিয়ে যাওয়ার জন্য বিত্তবান ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সরকারি সহযোগিতার আশায় প্রহর গুনছে হাছিনুর ও তার পরিবার। তার বিশ্বাস কেউ না কেউ তাকে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসবেই।
পার্শ্ববর্তী উপজেলা কাহারোল। এই উপজেলার আশ্রয়ন প্রকল্পের বাসিন্দা পিতৃহীন মোহাম্মদ আলী মানুষের বাসায় দিনমজুরের কাজ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। ‘খ’ ইউনিটে মেধা তালিকায় ৬৬৮তম হয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে সে।
পিতৃহীন মোহাম্মদ আলী উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়ায় মা মোছা. মসলিমা বেগম খুশিতে দিশেহারা। কিন্তু খুশিতে ভাটা পড়ে সন্তানের ভর্তির ও পড়ালেখার খরচ চালানোর অর্থাভাবে।
মোহাম্মদ আলী জানায়, সারদিন মায়ের সঙ্গে দিন মজুরের কাজ করে রাত জেগে পড়া লেখা করতাম। এইচএসি পাস করার পর ধরেই নিয়েছিলাম হয়তো আর পড়ালেখা করা হবে না। এসময় জাহাঙ্গীর নামে স্থানীয় এক বড়ভাইয়ের সহযোগিতায় ভর্তি ফরম পূরণ করি এবং পরীক্ষা দেই।
মোহাম্মদ আলী আরো জানায়, ২৪ অক্টোবর ভর্তির শেষ সময়। ভর্তি হতে অনেক টাকা লাগবে। মা ছেলে মিলে দিনমজুরের কাজ করে যে টাকা পায় তা দিয়ে তাদের সংসার চলে। তাই স্বপ্ন পূরণে বিত্তবান ও হৃদয়বানদের সহযোগিতা কামনা করেছে মোহাম্মদ আলী।