ঢাকার সরকারি তিতুমীর কলেজ থেকে সবে স্নাতকোত্তর করেছেন শাহাবাজ খান শিবলী। ছাত্রজীবন থেকেই একটি বেসরকারি মোবাইল অপারেটর কোম্পানিতে চাকরি করতেন এই তরুণ। সরকারি চাকরি নেবেন বলে টাকা জমা করেছিলেন আগে থেকেই। টাকার বিনিময়ে চাকরির চুক্তিও করেছে শাহাবাজের পরিবার। কিন্তু গণমাধ্যমে রোহিঙ্গাদের দুর্দশার চিত্র দেখে শুক্রবার (১৫ সেপ্টেম্বর) সেই টাকা নিয়েই সাহায্য করতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছুটে এসেছেন শাহাবাজ।
একশ টাকার কয়েকটি বাণ্ডিল নিয়ে অসহায় রোহিঙ্গাদের মাঝে ঘুরে ঘুরে বিলি করছেন শাহাবাজ। সর্বহারা মানুষদের মুখে হাসি ফুটিয়ে প্রশান্তির ছায়া মিলছে এই তরুণের মাঝেও।
উখিয়া-টেকনাফ যেন বাংলাদেশের মধ্যে আরেক ‘বাংলাদেশ’। আর শাহাবাজরাই সেই মানবিক বাংলাদেশের প্রতিনিধি।
মিয়ানমার তার নাগরিকদের রাষ্ট্রহীন করছে। মানবিকতা সেখানে ডুকরে কাঁদছে। নিজ দেশের একটি জাতিসত্তাকে নিধনের মিশনে খোদ রাষ্ট্রই নেমেছে। যে সীমানা বহিরাগতদের ঠেকাতে কাঁটাতারে ঘিরে রাখা, তা মিয়ানমার আজ খুলে দিয়েছে তারই নাগরিকদের তাড়াতে। নির্দয় মিয়ানমার অমানবিকতার চরম পরিচয় দিচ্ছে মানুষ হত্যা করে।
অন্যদিকে মিয়ানমারের নিষ্ঠুরতা বন্ধে বিশ্ব মোড়লরা এখনও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টো এশিয়ার দুই পরাশক্তি চীন এবং ভারত মিয়ানমার সরকারকেই সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তুরস্ক, ইরান ও ইন্দোনেশিয়া মিয়ানমারে গণহত্যার প্রতিবাদ জানালেও তা কাজে আসছে না।
মিয়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধ চলছে না বাংলাদেশের। প্রতিবেশি দেশটির সঙ্গে সীমানা বিরোধ থাকলেও তা চরমে ওঠেনি কখনই। তবুও আজ যুদ্ধের চাপ সামলাতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
লাখ লাখ রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে ‘মানবিক বাংলাদেশে’ আশ্রয় নিচ্ছে। বাংলাদেশের সীমানায় কড়া নিরাপত্তায় রয়েছে বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ)। তবুও বিজিবির গুলিতে কোনো রোহিঙ্গা মারা গেছে বলে খবর মেলেনি। কোথাও হয়তো বাধা মিলেছে, কিন্তু নিষ্ঠুরতা মেলেনি। বিজিবির চোখের সামনে দিয়েই বাংলাদেশে প্রবেশ করছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা।
আর এপারে এসেই সর্বহারা রোহিঙ্গারা পাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রাণ। যে প্রাণে প্রাণ মিলিয়ে ফের বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছেন তারা।
কক্সবাজার আর বান্দরবানের রোহিঙ্গা পাড়া যেন ভালোবাসার চাদরে ঢেকে গেছে। রোহিঙ্গা, মুসলিম, হিন্দু বা রাখাইনদের জাতিসত্তার পরিচয় ভুলে গেছে বাংলাদেশ। ‘মানুষ’ রোহিঙ্গাকে আগলে রাখতে যারপরনাই উদার হয়েছে বাঙালি আর বাংলাদেশ।
সব রোহিঙ্গাকে আর ফেরত নেয়া হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে মিয়ানমার সরকার। আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এসে বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন সভ্যতার এই অসহায় মানুষদের।
রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন সংগঠন আর ব্যক্তি। লাখো প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশের প্রাণ আজ উদ্বেলিত। ভারতের প্রখ্যাত গায়ক ভুপেন হাজারিকার সেই বিখ্যাত ‘মানুষ মানুষের জন্য’গানের মর্মবাণী মিলছে বাংলাদেশের পাহাড় দেশে। এখানে সবাই সবার। এখানে সবাই আপন।
‘কেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে ঢাকা থেকে ছুটে আসা’এমনটি জানতে চাওয়া হয় তরুণ শাহাবাজের কাছে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘চাকরি নেব বলে টাকা জমা করেছিলাম। সেই টাকাই বিলিয়ে দিলাম। চাকরির টাকা ফের জমানো যাবে। কিন্তু এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ হয়তো আর মিলবে না। মানুষ হিসেবে যে দায়, তা অনুভব করেই ছুটে এসেছি।’
চট্টগ্রামের এক বণিক সমিতির পক্ষ থেকে ত্রাণ দিতে কয়েকজন সদস্য আসেন বালুখালি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। সমিতির সদস্য আমানউল্লাহ বলেন, গণমাধ্যমে রোহিঙ্গাদের করুণ অবস্থা দেখে এখানে ত্রাণ নিয়ে এসেছি। এসে দেখি চরম মানবিক বিপর্যয়। এই পরিস্থিতির মধ্যে তো বসে থাকতে পারি না। ওরা (মিয়ানমার) রোহিঙ্গাদের মারছে, আর আমরা সামান্য সাহায্য নিয়ে এসেছি এই অসহায়দের বাঁচাতে ।
উল্লেখ্য, গত ১২ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের দেখতে গিয়েছিলেন। সেখানে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত ও নারকীয় তাণ্ডব, নির্বিচারে হত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের বর্ণনা শুনে অশ্রুসিক্ত হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
পরে দেয়া সংক্ষিপ্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমারে যা ঘটছে, সেটি মানবাধিকার লঙ্ঘন। প্রধানমন্ত্রী বাকরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, এ ঘটনা দেখে চোখের পানি ধরে রাখা যায় না। মানুষ মানুষের মতো বাঁচবে। মানুষের কেন এত কষ্ট।