পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত একটি ডেইরি বোর্ড গঠনের মাধ্যমেই দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশে দুধ ও মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব। ডেইরি বোর্ড ও নীতি সহায়তার অভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পশুখাতের উন্নয়ন। তাই খামারিদের ঋণ ব্যবস্থাকে সহজীকরণ করা, বীমা সুবিধা ও উৎপাদন ব্যবস্থায় খামারিদের খরচ কমিয়ে আনা ছাড়াও দুধ ও গরু আমদানি বন্ধের সুপারিশ করা হয়।
শনিবার রাজধানীতে আয়োজিত ‘গরুর অর্থনীতি : সংকট ও সমাধান’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা। বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল জার্নালিস্ট অ্যান্ড এক্টিভিস্ট ফেডারেশন (বিএজেএএফ) আয়োজিত সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রাণী সম্পদ অধিদফতরের (ডিএলএস) মহাপরিচালক ডা. মো. আইনুল হক। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএজেএএফের সাংগঠনিক সম্পাদক সাহানোয়ার সাইদ শাহীন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অমিয় ঘটক পুলক।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, দেশে গতবছর প্রায় ১ কোটি ৪৮ লাখ ৬৫ হাজার টন তরল দুধের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ৯২ লাখ ৮৩ হাজার টন। ফলে দেশে গত বছর দুধের ঘাটতি ৫৫ লাখ ৮২ টন। অন্যদিকে গত বছর দেশে পশু কোরবানি হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৫ লাখ। চলতি বছর দেশের বাজারে সরবরাহের জন্য প্রস্তুত রয়েছে ১ কোটি ১৫ লাখ ৫৭ হাজার পশু। চাহিদা ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও পশুর কোনো ঘাটতি হবার কথা নয়। কিন্তু তারপরেও প্বার্শবর্তী দেশ থেকে গরু আমদানি হচ্ছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ৩ লাখ ৬৫ হাজার গরু দেশে প্রবেশ করেছে।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল হক বেগ বলেন, চার দশকে দেশ একটি ডেইরি বোর্ড গঠন করতে পারল না। সেই বোর্ডকে একটি কার্যকর মিশন ও ভিশন দিতে পারলে দেশের দুগ্ধ শিল্প যেমন গতি পেত তেমনি নারী কর্মসংস্থান ও দারিদ্রতা দ্রুত হারে কমিয়ে আনা সম্ভব।
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাদিক এ্যাগ্রোর স্বত্বাধিকারী মো. ইমরান হোসেন বলেন, দুধ আমদানি ও গরুর অনুপ্রবেশ বন্ধের পাশাপাশি সরকারের সুনজর থাকলে মাংস ও দুগ্ধ শিল্প দেশে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব। উন্নত প্রযুক্তি, অর্থায়ন ও বিপণন সুবিধার পাশাপাশি নীতি সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।
দেশের পশুসম্পদ খাতে প্রতি বছর ১০-১২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রয়োজন বলে জানান এসিআই এগ্রিবিজনেসেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড. ফা হ আনসারী। এই বিনিয়োগ বাড়াতে হলে সরকারি খাতের নীতি সহায়তা বেসরকারি খাত বান্ধব করতে হবে। পাশাপাশি পশু পালনের জন্য ব্রিডিং, ভাকসিন ও সিমেন আমদানি বেসরকারি খাতের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। সরকারিভাবে ২৫-৩০ বছর আগের সিমেন দিয়ে গরু উৎপাদন কমিয়ে আনতে হবে।
বাংলাদেশ প্রাণীসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিএলআরআই) সাবেক মহাপরিচালক ও কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম চামড়ার দাম কমানোর সমালোচনা করে বলেন, কয়েক বছরে চামড়ার রফতানি দ্বিগুণ হয়েছে কিন্তু চামড়ার দাম চলতি বছরে অর্ধেকে নামানো হয়েছে।
ডা. মো. আইনুল হক বলেন, দেশে উৎপাদিত পশু দিয়েই এবারের কোরবানির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। দুগ্ধ খাতে ঋণ দেয়া হলেও সব ধরনের পশু পালনে সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের কার্যক্রম শিগগিরই শুরু করা হবে। এছাড়া খামারিদের নিরাপত্তায় বীমা চালু করা হবে।
গো খাদের অস্বাভাবিক দামের বিষয়টি উল্লেখ করে কক্সবাজার ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী মোরশেদ আহাম্মদ বলেন, গো-খাদ্যের বেশি দামের কারণে উৎপাদন খরচ বেশি হচ্ছে। আবার উৎপাদন ও বিক্রয় মৌসুমে গরু ও দুধ আমদানি উন্মুক্ত রাখার কারণে খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ডিএলএসের পরিচালক (সম্প্রসারণ) ডা. মো. মেহেদী হাসান বলেন, কয়েক বছরের ব্যবধানে ডিম, ব্রয়লার আমদানির প্রয়োজন হচ্ছে না। সামনের দিনে মাংস ও দুধ আমানি বন্ধ করতে সহায়ক নীতিমালা ও বোর্ড গঠন করা হচ্ছে। এছাড়া দুগ্ধ নীতিমালা প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে। এসব বাস্তবায়ন হলে দেশে দুধ ও মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আসবে স্বল্প সময়ে।
সেমিনারে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) সাবেক পরিচালক ড. এম আসাদুজ্জামান, ডিএলএসের সাবেক মহাপরিচালক মোসাদ্দেক আলী, বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাহ এমরান, কেয়ার বাংলাদেশের পরিচালক আনোয়ারুল হক, প্রাণ-ডেইরি লিমিটেডের চিফ ডেইরি (অপারেশন) ডা. মো. রাকিবুর রহমান, পিকেএসএফের মহাব্যবস্থাপক ড. শরিফ আহমেদ চৌধুরী, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইরি বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান আশিকুর রহমান, কেন্দ্রীয় ভেটেরিনারী হাসপাতালের চিফ ভেটেরিনারী অফিসার (সিভিও) ডা. মো. আবদুল হালিম ও ডিএলএসের সাবেক পরিচালক (উৎপাদন) ডা. অরবিন্দ কুমার সাহা।