ঝুলে আছে সরকারি কর্মচারী আইন। সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের পরিচালনার জন্য আইন প্রণয়নের বাধ্যবাধকতা থাকলেও এখন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত কোনো আইন হয়নি। আইনের খসড়া করা হলেও সেটি চূড়ান্ত করার কাজ পিছিয়ে যাচ্ছে বারবার।
সর্বশেষ গত বছরের ২৪ নভেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকে সরকারি কর্মচারী আইনের খসড়াটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হয়। মন্ত্রিসভা তা অনুমোদন না দিয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে উপস্থাপনের নির্দেশনা দেয়। এরপর আর এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনটি এবারও ঝুলে গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল মঙ্গলবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. রকিব হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘মন্ত্রিসভার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী আইনের খসড়াটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হলে এটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে।’
মন্ত্রিসভা বৈঠকে উপস্থাপনের জন্য কবে নাগাদ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে- জানতে চাইলে অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘এই মুহূর্তে সেটা বলা যাচ্ছে না।’
মঙ্গলবার মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ক্যারিয়ার প্ল্যানিং অ্যান্ড ট্রেনিং অণুবিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক সরকারি কর্মচারী আইন দ্রুত প্রণয়নে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা দেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে জানান, সরকারি কর্মচারী আইনটি চূড়ান্ত করতে কোনো উদ্যোগ নেই বলতে গেলেই চলে। এটি এক রকম পড়ে আছে।
সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগ, পদোন্নতি, জ্যেষ্ঠতা, ছুটি, পদায়ন, প্রেষণ, লিয়েন, ক্যাডার সার্ভিস, শৃঙ্খলা ও আচরণ, অবসর, পদত্যাগ, স্বেচ্ছা অবসর ও অক্ষমতাজনিত অবসর, পদোন্নতির জন্য পরীক্ষা ও কর্মমূল্যায়ন, ক্যারিয়ার প্ল্যানিং ও দক্ষতা উন্নয়ন, উচ্চ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণসহ আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে সমন্বিত কোনো আইন নেই।
আইন প্রণয়ন না করে সরকারগুলো বিধি, নীতিমালা ও প্রয়োজন মতো নির্দেশনাপত্র জারি করে সরকারি কর্মচারীদের পরিচালনা করে আসছে। বিভিন্ন সময়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, খসড়া হয়েছে। কিন্তু ভেস্তে গেছে সেসব উদ্যোগ।
২০১০ সালে ‘গণকর্মচারী আইন (পাবলিক সার্ভেন্ট আইন)’ খসড়া প্রণয়ন করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। দুই বছর ধরে সভা-সেমিনার করে এবং সাধারণ মানুষের মতামত নিয়ে এর খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। তবে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা খসড়ায় উল্লেখ থাকা পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতি পদ্ধতির ঘোরতর বিরোধিতা করায় খসড়াটি বাতিল করা হয়। এরপর ২০১২ সালে ‘সরকারি কর্মচারী আইন’ নামে নতুন একটি আইনের খসড়া করে সরকার।
নতুন খসড়া আইনে কর্মচারীদের আউটসোর্সিং করার প্রস্তাব থাকায় এর বিরোধিতা শুরু করেন কর্মকর্তারা। তাই এ খসড়াটিও চূড়ান্ত করা যায়নি।
কয়েক দফা উপস্থাপনের পর ২০১৪ সালের ৩ আগস্ট প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির সভায় ‘সরকারি কর্মচারী আইন, ২০১৪’ এর খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। এ খসড়া আইনেরও কিছু ধারা নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা ছিল। সেই খসড়াটিও আর আলোর মুখ দেখেনি।
২০১৫ সালে ১২ জানুয়ারি নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সরকারি কর্মচারী আইন নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। ফের খসড়া করা হয়।
সেই খসড়ায় সরকারি কর্মচারীদের শৃঙ্খলার বিষয়ে বলা হয়- সরকারি কর্মচারীর দায়িত্ব পালন সংক্রান্ত কোনো অপরাধের অভিযোগে সাংবিধানিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত সংস্থা তদন্ত করতে এবং উপযুক্ত আদালতে অভিযোগ দায়ের করতে পারবে। তবে এ সংক্রান্ত ফৌজদারি মামলায় আদালতের অভিযোগপত্র গৃহীত হবার আগে কর্মচারীকে গ্রেফতারের প্রয়োজন হলে সরকারের পূর্ব-অনুমোদন লাগবে।
ধারাটি নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এরপরও ২০১৫ সালের ১৩ জুলাই খসড়াটি মন্ত্রিসভা বৈঠকের নীতিগত অনুমোদন পায়। খসড়াটি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের ভেটিং (পরীক্ষা-নীরিক্ষা) শেষে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আবার মন্ত্রিসভায় উঠে এক বছর চার মাসেরও বেশি সময় পর।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, নীতিগত অনুমোদনের সময় সরকারি কর্মচারী আইনের খসড়াটি ছিল ১৬ ধারার ছোট একটি আইন। আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংয়ের পর এটা ৭১টি ধারার অনেক বড় আইন হয়ে যায়। এজন্য মন্ত্রিসভা পরবর্তী সময়ে ঝুঁকি এড়াতে এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া অনুমোদন দিতে রাজি হয়নি।