দেশের খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ মুক্তিযোদ্ধা জহির রায়হানের ৮২তম জন্মবার্ষিকী আজ শনিবার (১৯ আগস্ট)। ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট তিনি বর্তমান ফেনী জেলার অন্তর্গত মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের পরপরই তার বিয়োগান্ত অন্তর্ধাণে হতবাক হয়ে যায় জাতি। মাত্র ৩৬ বছরের জীবনে চলচ্চিত্র ও সাহিত্য উভয় ক্ষেত্রে তিনি তার প্রতিভার যে স্বাক্ষর, সৃষ্টিশীলতায় যে ফসল রেখে গেছেন, নিঃসন্দেহে তা তাকে অমর করে রেখেছে।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি তার পরিবারের সাথে কলকাতা হতে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) স্থানান্তরিত হন। তিনি ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬১ সালে সুমিতা দেবীকে এবং ১৯৬৬ সালে সুচন্দাকে বিয়ে করেন। দুজনেই ছিলেন সে সময়কার বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী।
১৯৫০ সালে তিনি যুগের আলো পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। পরবর্তীতে জহির রায়হান খাপছাড়া, যান্ত্রিক, সিনেমা ইত্যাদি পত্রিকাতেও কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি সম্পাদক হিসেবে ‘প্রবাহ’ পত্রিকায় যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সূর্যগ্রহণ’ প্রকাশিত হয়।
চলচ্চিত্র জগতে জহির রায়হানের পদার্পণ ১৯৫৭ সালে, ‘জাগো হুয়া সাবেরা’ ছবিতে সহকারী হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে। তিনি সালাউদ্দীনের ছবি ‘যে নদী মরুপথে’-তেও সহকারি হিসেবে কাজ করেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশাম তাকে ‘এ দেশ তোমার আমার’-এ কাজ করার আমন্ত্রণ জানান। জহির রায়হান এ ছবির নামসংগীত রচনা করেছিলেন।
১৯৬০ সালে তিনি রুপালি জগতে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ‘কখনো আসেনি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ১৯৬৪ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘সঙ্গম’ নির্মাণ করেন এবং পরের বছর তার প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র ‘বাহানা’ মুক্তি দেন।
জহির রায়হান ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং ২১ ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক আমতলা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। ভাষা আন্দোলন তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল, যার ছাপ দেখতে পাওয়া যায় তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেওয়া’ চলচ্চিত্রে। তিনি ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন।
কলকাতায় তার নির্মিত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেওয়া’র বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয় এবং চলচ্চিত্রটি দেখে সত্যজিত রায়, মৃণাল সেন, তপন সিনহা এবং ঋতিক ঘটক প্রমুখ ভূয়সী প্রশংসা করেন। সে সময়ে তিনি চরম অর্থনৈতিক দৈন্যের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তার চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হতে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ তিনি মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করে দেন।
সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য আদমজী সাহিত্য পুরস্কার ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান এই গুণী শিল্পী। তার লেখা অন্য গ্রন্থগুলো হলো ‘তৃষ্ণা (১৯৬২)’, উপন্যাস- একুশে ফেব্রুয়ারি (১৯৭০), ‘কয়েকটি মৃত্যু’, ‘শেষ বিকেলের মেয়ে(১৯৬০)’, ‘হাজার বছর ধরে (১৯৬৪)’, ‘আরেক ফাল্গুন (১৯৬৯)’, ‘বরফ গলা নদী (১৯৬৯)’, ‘আর কত দিন (১৯৭০)’ ইত্যাদি।
জহির রায়হানকে স্মরণ করে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজিত দু’দিনব্যাপী ‘জহির রায়হান চলচ্চিত্র উৎসব’ করছে। যার শ্লোগান ‘প্রতিরোধে প্রস্তুত ক্যামেরা’। ১৮ আগস্ট শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর সঙ্গীত, আবৃত্তি ও নৃত্যকলা কেন্দ্র মিলনায়তনে আয়োজিত এ উৎসবের উদ্বোধন করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি ড. সফিউদ্দিন আহমেদ। উদ্বোধনী পর্বে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জহির রায়হান’র পুত্র অনল রায়হান এবং উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি মাহমুদ সেলিম।
দুপুর ১২টা থেকে শুরু হয় চলচ্চিত্র প্রদর্শনী। শুরুতেই প্রদর্শিত হয় একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনির নির্মম ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ওপর জহির রায়হান নির্মিত চলচ্চিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’। এরপর উদীচী কেন্দ্রীয় চলচ্চিত্র ও চারুকলা বিভাগ প্রযোজিত এবং প্রদীপ ঘোষ রচিত ও নির্দেশিত প্রামাণ্যচিত্র ‘ভাষানপানি’ প্রদর্শিত হবে।
শনিবার সকাল ১০টা থেকে শুরু হয়েছে উৎসবের দ্বিতীয় ও শেষ দিনের অনুষ্ঠানমালা। এদিন দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে প্রদর্শিত হবে প্রজন্ম টকিজের সালেহ সোবহান অনীম নির্মিত ‘পুনরাবৃত্তি’ ও সাঈদ আহমেদ সাকী নির্মিত ‘উপসংহার’ এবং জাহিদুর রহিম অঞ্জন নির্মিত ‘মেঘমল্লার’। এসব চলচ্চিত্র প্রদর্শনী সবার জন্য উন্মুক্ত।