নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এগিয়ে চলছে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ। যে করেই হোক ২০১৮ সাল নাগাদ নির্ধারিত সময়ে বহুল আলোচিত এ সেতুর কাজ শেষ করতে চায় সরকার।
কিন্তু সম্প্রতি নির্মাণকাজ বিঘ্নিত হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে পদ্মা সেতু সম্পন্ন হবে কি না- তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
পদ্মা সেতু সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সেতু নির্মাণ পয়েন্টে পদ্মা নদীতে তীব্র স্রোতের কারণে পাইলিং করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া নদীর তলদেশে মাটির গঠনগত সমস্যা রয়েছে। এজন্য পদ্মা সেতুর পিলারের দৈর্ঘ্য কত হবে, তা নির্ধারণ নিয়েও দেখা দিয়েছে জটিলতা।
সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নদীর তলদেশে মাটির ভিন্নতার কারণে সেতু নির্মাণ পয়েন্টে ১৪টি পেয়ার (প্রতিটি পেয়ারে থাকছে ছয়টি করে পিলার) স্থাপন করা যাচ্ছে না। এ সমস্যা নিরসনে ব্রিটিশ একটি কনসালটেন্ট প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন পাওয়ার পর সেতুর পরবর্তী কার্যক্রম সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
এ প্রসঙ্গে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) শফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘পদ্মা সেতু অঞ্চলে কিছু এলাকায় মাটির সমস্যা রয়েছে। সমস্যা থাকবেই। এ সমস্যায় করণীয় নিয়ে একটি ব্রিটিশ ফার্মকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা আগামী মাসের শেষের দিকে ডিজাইন জমা দেবে। সেই ডিজাইন হাতে পেলে পেয়ার স্থাপনে রি–ডিজাইন করা হবে।’
নতুন করে নকশার কারণে সেতুর কাজ পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সমস্যা নতুন কিছু নয়, প্রতিনিয়তই সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে এবং আমরা তা মোকাবেলা করে যাচ্ছি। যে করেই হোক নির্ধারিত সময়ে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ করা হবে। যেসব সমস্যা আমরা নিজেরা সমাধান করতে পারছি না, সেখানে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিচ্ছি। কাজ দ্রুত করতে সক্ষমতা বাড়াচ্ছি।’
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, মূল নকশায় মাটির নিচে ৯০ থেকে ১২০ মিটার গভীর পর্যন্ত পাইল বসানোর কথা বলা হয়েছিল। সেই অনুসারে কাজ শুরুও হয়। কিন্তু পাইল বসাতে গিয়ে দেখা যায়, ১৩০ মিটার গভীর পর্যন্ত শক্ত মাটি বা পাথরের স্তর নেই, যা সেতুর প্রয়োজনীয় ভার বহনের সক্ষমতা বাড়ায়। সাধারণত মাটির নিচের শক্ত স্তর পর্যন্তই পাইলিং করা হয়।
যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের সময় ৭৮ মিটার মাটির নিচেই শক্ত পাথরের স্তর পাওয়া যায়। এ পরিস্থিতিতে পদ্মা নদীর তলদেশের মাটি একাধিকবার পরীক্ষা করা হয়। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা একাধিক বৈঠক করে গত মার্চে কিছু পাইল আরও গভীর করার সিদ্ধান্ত দেন। মোট ২৪০টি পাইলের মধ্যে ১২৬টি পাইল নকশায় উল্লেখ করা গভীরতায় বসালেই চলবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
এর আগে, ২০০৯ সালে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে সরকার। ওই কমিটির উদ্দেশ্য ছিল প্রকল্পের কারিগরি বিষয়ে দিক-নির্দেশনা দেয়া। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে ওই আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ কমিটি এখনও কাজ করছে। ১০ সদস্যের ওই কমিটিতে জাপানের তিনজন, নেদারল্যান্ডসের একজন এবং নরওয়ের একজন বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। বাকি পাঁচজন বাংলাদেশের।
ওই কমিটির অন্যতম সদস্য বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক শামীম জেড বসুনিয়া সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘যে যাই বলুক ২০১৮ সালে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হবে না। পুরোপুরি না হলেও ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কাজ ওই সময়ের মধ্যে শেষ হবে। ২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে গিয়ে এটি শেষ হতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তবে এ নিয়ে সরকারের সমালোচনা করার কিছু নাই। কারণ সরকার ও সংশ্লিষ্টদের নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। সবাই চায় পদ্মা সেতু হোক।’
ওই অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘খরস্রোতের কারণে পদ্মার প্রায় ১৪টি পেয়ারের পুরোপুরি নির্মাণ পিছিয়ে যাবে। সব মিলিয়ে ৮৪টি পিলারের নির্মাণকাজ পিছিয়ে যাচ্ছে। তাই শত আন্তরিকতা থাকলেও ২০১৯ সালের আগে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হবে না।’
তবে অধ্যাপক বসুনিয়ার ওই আশঙ্কার কথা মানতে নারাজ সেতু বিভাগ। তারা বলছে, পদ্মা সেতুর কাজ চলছে। সেতুর অন্য প্রকল্পগুলোর কাজ সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রায় শেষের দিকে। নদীর খরস্রোত এবং তলদেশের মাটির স্তরের গঠনসহ নানা প্রতিকূলতা কাটিয়ে এগিয়ে চলেছে মূল সেতুর পাইলিংয়ের কাজ।
একই কথা বলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এটা তরুণ প্রজন্মের একটি ড্রিম প্রজেক্ট। প্রধানমন্ত্রীর ফার্স্টট্র্যাকভুক্ত (অগ্রাধিকারমূলক) প্রকল্পের অন্যতম এটি। ২০১৮ সালেই চলাচলের জন্য আমরা এটি উন্মুক্ত করব। প্রতিবন্ধকতা তো আসবেই।
তিনি বলেন, এ প্রকল্পে অর্থায়ন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে অনেক জায়গাতেই যড়যন্ত্র হয়েছে। আমরা সব বাধা পেরিয়ে নিজ অর্থায়নে এটি করছি। আশা করি নির্দিষ্ট মেয়াদেই কাজ শেষ হবে। কোনো সমস্যা হবে না। সবকিছু ঠিকঠাক চলছে।
৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতুর শুরু থেকেই মাওয়া প্রান্তে মাটির তলদেশের গঠন বৈচিত্র্যের কারণে দৈর্ঘ্য নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। এই প্রান্তে ৬ ও ৭ নম্বর পিলারের কাজ ধরা হলেও পরে তা অর্ধসমাপ্ত রেখেই কাজ সরিয়ে নেয়া হয় জাজিরা প্রান্তে। জাজিরা প্রান্তে ৩৬ থেকে ৪২ নম্বর পিলার পর্যন্ত কাজ চলছে পুরোদমে। তবে মাওয়া প্রান্তে ১ নম্বর এবং ৬ থেকে ১২ নম্বর পিলারের দৈর্ঘ্য কত হবে তা এখন পর্যন্ত নির্ধারণ করা যায়নি। ফলে অন্য পিলারগুলোর কাজ শুরু হলেও বন্ধ আছে এর কয়েকটি পিলারের কাজ।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়ন করতে আগ্রহ প্রকাশ করে। তবে ২০১২ সালে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি স্থগিত করে বিশ্বব্যাংক। এতে অনিশ্চয়তায় পড়ে সেতু নির্মাণের ভবিষ্যৎ। পরবর্তীতে সরকার বিশ্বব্যাংকের অর্থ না নিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। সে অনুযায়ী বর্তমানে এগিয়ে চলছে সেতুর নির্মাণকাজ।