বাংলা সিনেমায় রবীন্দ্র সাহিত্য

বাংলা সিনেমায় রবীন্দ্র সাহিত্য

বাংলা ও বাঙালির অনুভূতির অভিধান তিনি। সাহিত্য, সংগীত, শিল্প এবং শিক্ষা ক্ষেত্রের এমন কোনো জগৎ নেই যেখানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বিচরণ করেননি। তার বিশাল সাহিত্য হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার সব কথাই বলে দিয়েছে অবলীলায়। তাই যুগের পর যুগ পেরিয়ে কমেনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টির আবেদন।

তার সৃষ্টি নিয়ে নাটক, সিনেমা তৈরি করা হয়েছে অনেক। দুই বাংলাতেই কবিগুরুর গল্প ও চরিত্ররা প্রাণবন্ত হয়েছে চলচ্চিত্রে। তুলনামূলক কলকাতায় রবীন্দ্র সাহিত্যের সিনেমা একটু বেশিই সমৃদ্ধ হয়েছে। তবে ঢাকাই ছবিতেও রবীন্দ্র চরিত্ররা বাজিমাত করেছেন।

বিশ্বকবির প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি সেইসব বাংলা সিনেমা নিয়ে এই নিবেদন-

ইতিহাস
১৮৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের ৩৪ বছর পর ১৮৯৫ সালে চলচ্চিত্রের উদ্ভাবন হয়। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য রবীন্দ্রনাথের নোবেল বিজয়ে আন্তর্জাতিকভাবে সবার দৃষ্টি কাড়ে বাংলা সাহিত্য। ১৯২০ সালে ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় প্রথম রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ গল্পের চলচ্চিত্রায়ণ করার উদ্যোগ নিলেও ১৯২৩ সালে নরেশচন্দ্র মিত্রের পরিচালনায় বাংলা চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রথম চিত্ররূপ ‘মান ভঞ্জন’।

এরপর ১৯২৮ সালে শিশির ভাদুড়ি ‘বিসর্জন’ ও ‘বিচারক’ নামের দুটি ছবি করেন। ১৯২৯ সালে ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ‘তপতী’ ছবিটি নির্মাণ শুরু করলেও চার রিল পর্যন্ত শুটিং হয়। বিশ্বকবি নিজে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়ের জন্য রাজি হলেও বিদেশ ভ্রমণের কারণে ছবির কাজ অসমাপ্ত থেকে যায়। ১৯৩০ সালে ‘দালিয়া’ ও ‘গিরিবালা’ নামের দুটি সাহিত্যকর্মের চলচ্চিত্রায়ণ হয়।

১৯৩২ সালে সবাক চলচ্চিত্র ‘নটীর পূজা’ ও ‘চিরকুমার সভা’ মুক্তি পায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিচালিত একমাত্র চলচ্চিত্র ‘নটীর পূজা’। মাত্র চার দিনে ছবির শুটিং শেষ করেছিলেন তিনি। শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীদের অভিনীত এ চলচ্চিত্রে উপালির চরিত্রে অভিনয় করেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। এরপর নরেশ মিত্রের নির্বাক ছবি ‘নৌকাডুবি (১৯৩৮)’, সবাক ছবি ‘গোরা (১৯৩৮)’, সেতু সেনের ‘চোখের বালি (১৯৩৮)’ নির্মিত হয়। এই সময়টা ছিলো সাহিত্য নির্ভর চলচ্চিত্রের সোনালী যুগ। দুই বিখ্যাত কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিসংবলিত কাহিনি, গান ও সুরে মুখর ছিলো বাংলা চলচ্চিত্রজগৎ।

তপন সিংহ পরিচালিত ‘কাবুলীওয়ালা’ ভারতের রাষ্ট্রপতির পদক, বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার ও ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। ১৯৬১ সালে চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় রবীন্দ্রনাথের তিনটি ছোটগল্প সমাপ্তি, পোস্টমাস্টার ও মনিহারা নিয়ে নির্মাণ করেন ‘তিনকন্যা’ ছবি। ‘তিনকন্যা’ ও ‘সমাপ্তির’ জন্য রাষ্ট্রপতি পদক, ‘পোস্টমাস্টার’ ও ‘সমাপ্তি’ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে মেলবোর্ন ও বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে, ‘নষ্টনীড়’ গল্প অবলম্বনে চারুলতা (১৯৬৪) রাষ্ট্রপতি পদক, বার্লিন ও মেক্সিকো চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ ছবি ও ঘরে বাইরে (১৯৮৪) ছবি ভারতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও দামাস্কাস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার পায়। ভারতে তখন রবীন্দ্র সাহিত্য চর্চার অন্যরকম মর্যাদা। তৎকালীন চলচ্চিত্র নির্মাতারা সেই মর্যাদাকে সবার কাছে ছড়িয়ে দিয়েছেন চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে।

আর বাংলাদেশের ছবিতে রবীন্দ্রনাথের কাহিনি ও গান এসেছে ১৯৫৭ সালে এফডিসি প্রতিষ্ঠার পর। তখন নিয়মিত ছবি নির্মাণ হতে থাকলেও কোনো নির্মাতা রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাস নিয়ে ছবি করার সাহস পেতেন না। বলা যায়, পশ্চিমা শাসকদের একধরনের অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা ছিল রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্ম নিয়ে ছবি করায়।

১৯৫৬ থেকে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ২০৭টি পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ও উর্দু ছবি নির্মিত হলেও এর মধ্যে সালাউদ্দিন পরিচালিত ১৯৬৩ সালে ‘ধারাপাত’ ছবিতে একটি ও ১৯৭০ সালে জহির রায়হান পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে একটি গান ব্যবহার করা হয় রবীন্দ্রনাথের। ১৯০৫ সালে রচিত রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি জহির রায়হান জীবন থেকে নেয়া ছবিতে ব্যবহার করেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের পর এটি আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

অবশ্য তার এক বছর আগে ১৯৬৯ সালে খান আতাউর রহমান পরিচালিত শবনম, রহমান অভিনীত ‘জোয়ার ভাটা’ ছবিতে ব্যাকগ্রাউন্ডে ‘গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ’ গানটি ব্যবহার করেন। ১৯৭২ সালে চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত স্বাধীনতাযুদ্ধের ওপর নির্মিত প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’ ছবিতে রবীন্দ্রনাথের ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা’ গানটি ব্যবহার করেন।

আজিজ আজহার পরিচালিত ১৯৭৪ সালে নির্মিত ‘চোখের জলে’ ছবিতে রবীন্দ্রনাথের গান ব্যবহার করা হয়। ১৯৮৪ সালে কাজল আরেফিন পরিচালিত ‘সুরুজ মিয়া’ ছবিতে অজিত রায়ের কণ্ঠে একটি রবীন্দ্রসংগীত, ১৯৮৫ সালে শেখ নিয়ামত আলীর ‘দহন’ ছবিতে কাদেরী কিবরিয়া, ১৯৯৪ সালে হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ‘আগুনের পরশমণি’ ও ২০০৮ সালে ‘আমার আছে জল’ ছবিতে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহার করা হয়।

সত্তর দশকের শেষের দিকে সাইফুল আজম কাসেম ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসের ছায়া অবলম্বনে নির্মাণ করেন ‘সোহাগ’ ছবিটি। এ ছবিতে কাহিনিকার হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানের এস এম ইউসুফের পরিচালনায় নাইয়ার সুলতানা, কামাল ও শামীম আরা অভিনীত উর্দুতে নির্মিত হয় ‘নৌকাডুবি’। সেখানকার উর্দু ছবিতে রবীন্দ্রনাথের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ১৯৮৪ সালে পরিচালক কাজী হায়াৎ ক্ষুধিত পাষাণ অবলম্বনে ‘রাজবাড়ী’ ছবিটি নির্মাণ করলেও ছবির টাইটেলে কাহিনিকার হিসেবে রবীন্দ্রনাথের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। চাষী নজরুল ইসলাম ২০০৫ সালে নির্মাণ করেন ‘শাস্তি’। একই বছর তিনি নির্মাণ করেন রবীন্দ্রনাথের গল্প অবলম্বনে ‘শুভা’। রবীন্দ্রসাহিত্যের সফল চলচ্চিত্রায়ণ ‘শাস্তি’ ও ‘শুভা’ দর্শকদের প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হয়।

এরপর ২০০৬ সালে কাজী হায়াৎ নির্মাণ করেন ‘কাবুলীওয়ালা’। এই ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন প্রয়াত নায়ক মান্না। ২০১০ সালে নার্গিস আক্তারের পরিচালনায় ‘সমাপ্তি’ গল্প অবলম্বনে নির্মিত হয় অবুঝ বউ।

তথ্যসূত্র : অনলাইন ও চলচ্চিত্র এবং রবীন্দ্র বিষয়ক গ্রন্থ

বিনোদন