বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃতির অভিযোগে আওয়ামী লীগ নেতার মামলা ও তার বিপরীতে কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় বরিশালের আগৈলঝড়ার সাবেক (বর্তমানে বরগুনা সদর) উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তারেক সালমান বলেছেন, ‘আদালতের নির্দেশ শুনে আমি খুবই অবাক হই, হতভম্ব হয়ে যাই। আমি কল্পনাও করিনি যে আমার জামিন নামঞ্জুর করা হবে। একটি জামিন-যোগ্য ধারায় মামলাটি করা হয়েছে এবং যথাযথভাবে আদালতের সামনে আমার বক্তব্য উপস্থাপন করেছে আমার আইনজীবী। জামিন নামঞ্জুর করার পর আমাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়। আমি খুবই অপমানিত বোধ করি।’
বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন তিনি।
গাজী তারিক সালমন যখন বুধবার সকালে বরিশালের চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজেস্ট্রেটের আদালতে হাজির হন, তখন বুঝতে পারেননি পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা তাকে কিরকম হেনস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আদালতের জারি করা এক সমনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে সেখানে হাজিরা দিতে হয়েছিল। তার জামিনের আবেদন নাকচ করে দিয়ে আদালত তাকে জেলে পাঠানোর নির্দেশ দেবেন, সেটা তিনি ভাবতেই পারেননি।
বরগুনা সদরের এই ইউএনওকে হাতকড়া পরিয়ে জেলে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে স্তম্ভিত হয়েছেন বাংলাদেশের আরও অনেক মানুষ। যে ধরনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়েছিল, সেরকম একটি মামলা যে করা যায়, আর সেই মামলায় একজন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তাকে এভাবে ধরে নিয়ে যাওয়া যায়, তা অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে।
এমনকি প্রধানমন্ত্রীর দফতরের কর্মকর্তারাও এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী।
অভিযুক্ত ওই ছবিটি সম্পর্কে ইউএনও তারেক সালমান জানিয়েছেন, ১৭ই মার্চ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম দিবসটি পালিত হয় জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে। সে উপলক্ষে আগৈলঝড়া উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে একটি চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস এইটের বাচ্চারা এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।
তিনি বলেন, ‘তখনই ঘোষণা দিয়েছিলাম যে/যারা প্রতিযোগিতায় প্রথম এবং দ্বিতীয় হবে তাদের ছবি ব্যবহার করেই ২৬শে মার্চের কার্ডটি ডিজাইন করা হবে। এই প্রতিযোগিতার থীম ছিল বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ।’
ঘোষণা অনুযায়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়া কার্ডটি ফ্রন্ট কাভারে এবং দ্বিতীয়টি ব্যাক কভারে ব্যবহার করে তার কার্ডটি ছাপান।
তিনি বলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের অংশ হিসেবেই এই কার্ডটি ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিই। বাচ্চাদের একটা ছবি ব্যবহার করি বাচ্চাদের উৎসাহ দেয়ার জন্য। আমি কল্পনাও করিনি যে এই কার্ডটি নিয়ে আমাকে এ ধরণের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। আমার বিরুদ্ধে এরকম অমূলক একটি মামলা দায়ের করা হবে।’
গাজী তারিক সালমন জানান, কার্ডে তাদের পরিচিতিও লেখা ছিল তারা কোন ক্লাসে পড়ে। ছিল তারা যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী তার নাম। বাচ্চাদের এই ছবি নিয়ে বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ ছিল না।
কিন্তু এতকিছুর পরও তার বিরুদ্ধে কেন এমন মামলা হলো এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি আট মাস বরিশালের আগৈলঝড়া উপজেলায় কর্মরত ছিলাম। এসময় আমাকে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ যাতে সঠিকভাবে যথাযথভাবে সম্পন্ন হয় সেজন্যে আমি তৎপর ছিলাম। কঠোর অবস্থানে ছিলাম। আমি সেখানকার আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করি। আমি অবৈধ স্থাপনা করতে দেইনি আমি যতদিন সেখানে ছিলাম। এসব কারণে সেখানকার প্রভাবশালীরা আমার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ ছিল। আমার অনুমান, তারা আমাকে হয়রানি করার জন্যই বাদীকে দিয়ে এই মামলাটি করিয়েছে।
উল্লেখ্য, গাজী তারেক সালমান বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) থাকাকালে গত স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে ছাপানো আমন্ত্রণপত্রে পঞ্চম শ্রেণিপড়ুয়া এক শিশুর আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবি ব্যবহার করেন।
এ ঘটনায় বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত ধর্মবিষয়ক সম্পাদক ও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সৈয়দ ওবায়েদুল্লাহ চলতি বছরের ৭ জুন বরিশাল মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে ওই ইউএনওর বিরুদ্ধে ৫ কোটি টাকার মানহানির মামলা করেন। মামলাটি আমলে নিয়ে বিচারক ২৭ জুলাইয়ের মধ্যে তারেক সালমানকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়ে সমন জারি করেন।
গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে তারেক সালমানকে বরগুনা সদর উপজেলায় বদলি করা হয়। গত বুধবার ওই মামলায় আদালতে হাজিরা দিয়ে জামিনের আবেদন করেন তারেক সালমান।
আদালত প্রথমে তা নামঞ্জুর করে ইউএনওকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এর দুই ঘণ্টা পর তার জামিন মঞ্জুর করা হয়। জানাজানি হলে বিষয়টি নিয়ে সারাদেশে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয়।