বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এআইইউবিতে (আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি- বাংলাদেশ) বিবিএ করছেন শাওন (২২)। প্রতি মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি’র নামে বাবা মোবারক খানের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিতেন। সন্দেহ হওয়ায় বাবা ছেলের গতিবিধি অনুসরণ করতে শুরু করেন।
গত এপ্রিলে ছেলেকে অনুসরণ করতে করতে হাজির হন গুলশান-তেজগাঁও লিংক রোডে অবস্থিত ‘ফুয়াং ক্লাবে’। সেখানে প্রবেশ করতেই দেখা মেলে ছেলের। ফুয়াং ক্লাবের ক্যাসিনোতে জুয়া খেলছিলেন শাওন। বিব্রত বাবা ছেলেকে ঘরে এনে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। একপর্যায়ে শাওন স্বীকার করেন টিউশন ফির নামে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে তিনি ক্যাসিনোতে জুয়া খেলতেন। এভাবে গত চার মাসে আট লাখ টাকা উড়িয়েছেন তিনি।
ছেলের এই অধপতন দেখে আতঙ্কিত হন মোবারক খান। শুধু নিজের ছেলে নয়, হাজার হাজার যুবককে জুয়ার ভয়াল ছোবল থেকে রক্ষা করতে নিজেই উদ্যোগ নেন। একে একে রাজধানীতে পরিচালিত ক্যাসিনোগুলো সরেজমিনে অনুসন্ধানে যান এবং সেগুলোর তালিকা তৈরি করেন। ওই তালিকার ভিত্তিতে কার্যকর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ করেন তিনি।
লিখিত ওই অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ‘রাজধানীর মতিঝিল ক্লাবপাড়ায় অবস্থিত ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, গুলশানের ফুয়াং ক্লাব, ধানমন্ডি ক্লাব, কলাবাগান ক্লাব, মালিবাগ মৌচাক মোড়ে ফরচুন মার্কেটের বিপরীতে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের চতুর্থ তলার সৈনিক ক্লাব, উত্তরায় র্যা ব- ১ এর বিপরীতে পূবালী ব্যাংকের তৃতীয় ও চতুর্থ তলার উত্তরা ক্লাব, এলিফ্যান্ট রোডের এজাজ ক্লাব, পুরানা পল্টনের জামাল টাওয়ারের ১৪ তলায় অবস্থিত ক্যাসিনোতে এ ধরনের আয়োজন চলছে। শুধু জুয়া নয়, দীর্ঘদিন ধরে এসব স্থানে অবৈধ মাদক বিক্রি ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে।’
‘ক্যাসিনোর কারণে যুব সমাজ ধ্বংসের পথে যাচ্ছে’- উল্লেখ করে এসব অবৈধ কর্মকাণ্ড দ্রুত বন্ধের জন্য আইনগত ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন মোবারক খান।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া ওই অভিযোগ সূত্রে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা হয় মোবারক খানের। তিনি বলেন, ফুয়াং ক্লাবে প্রবেশ করে আমি নিজ চোখে দেখেছি, সেখানে ৮-১০টির মতো টেবিল বসিয়ে টোকেনের মাধ্যমে জুয়া খেলা হচ্ছে। বিদেশি মেয়েরা তা পরিচালনা করছেন। সরেজমিনে দেখে এবং তাদের কথা শুনে মনে হয়েছে তারা নেপালের নাগরিক। যারা জুয়া খেলছেন তাদের অধিকাংশই যুবক, তবে অনেক বয়স্কও রয়েছেন।
তিনি বলেন, শুধু আমার ছেলেই নয় রাজধানীর হাজার হাজার যুবককে জুয়ার মরণফাঁদ থেকে রক্ষা করতে আমি নিজেই উদ্যোগ নিয়েছি। একে একে বেশ কয়েকটি ক্যাসিনো পরিদর্শন করেছি। সবগুলোতে উঠতি বয়সী যুবকদের দেখা গেছে। যে কাজটি প্রশাসনের করার কথা সেটি নিজ উদ্যোগে আমি করেছি। মাদকের মতো জুয়ার এই মরণ নেশা থেকে অবশ্যই আমাদের সন্তানদের রক্ষা করতে হবে। আমি আমার কাজ করেছি, এখন বাকি কাজ প্রশাসনের।
শুধু মোবারক খান নন, এমন বেশ কয়েকটি অভিযোগ জমা পড়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি যাচাই-বাছাই করে ক্লাবগুলোর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ দিয়ে সম্প্রতি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সকে চিঠি দেয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপ-সচিব তাহমিনা বেগম জাগো নিউজকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের পাঠানো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে ক্যাসিনোগুলোর নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘বর্ণিত অভিযোগটির বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত-সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক গৃহীত কার্যক্রম সম্পর্কে কার্যালয়কে অবহিত করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’
এ বিষয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) সোহেলি ফেরদৌস জাগো নিউজকে বলেন, আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পেয়েছি। যেসব প্রতিষ্ঠানের ক্লাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে আমরা সেসব যাচাই-বাছাই করছি। এগুলোর একটি তালিকা করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশকে (ডিএমপি) চিঠি দেয়া হবে। আমরা ডিএমপিকে বলব, তথ্যপ্রমাণ পেলে সেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।
সম্প্রতি গুলশান-তেঁজগাও লিংক রোডের ফুয়াং ক্লাবে জুয়া খেলেছেন এমন চারজনের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। তাদের (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বর্ণনা অনুযায়ী, ক্লাবের প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার পর ডান দিকের প্রথম ভবনটিতে ক্যাসিনো রয়েছে। ভেতরে ১৫টি ক্যাসিনো বোর্ড। প্রতিটি বোর্ডের পাশে হলুদ রঙের শার্ট আর কালো রঙের প্যান্ট পরা ২০-২২ বছরের তিনজন করে তরুণী অবস্থান করেন। হলরুমে প্রবেশ করতেই হাতের বাম দিকে চিপস বিক্রির কাউন্টার।
চিপস বলতে এক ধরনের প্লাস্টিকের কয়েনকে বোঝায়। টেবিলের ওপর এটা রেখে বাজি ধরে জুয়া খেলা হয়।
সেখানে জুয়া খেলেছেন এমন একজন জাগো নিউজকে বলেন, দাঁড়িয়ে থাকা তরুণীরা মূলত খেলোয়াড়দের বেশি বেশি অর্থ বাজি ধরার জন্য উৎসাহিত করেন।
ফুয়াং ক্লাব প্রসঙ্গে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) বিপ্লব কুমার সরকার জাগো নিউজকে বলেন, আগে এ ধরনের অভিযোগ উঠেছিল। দুই মাস আগে মাননীয় ডিএমপি কমিশনার (আছাদুজ্জামান মিয়া) আমাদের এগুলো বন্ধের নির্দেশ দেন। আমরা সেগুলো বন্ধ করে দিয়েছি। নতুন করে তদন্তের জন্য পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সের কোনো আদেশ আমরা এখনও পাইনি।
জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে কলাবাগান ক্লাবের একজন ক্রিকেটার জানান, রমজান মাসের শেষদিকে একদিন রাতে ক্লাবের ভেতর ক্যাসিনোতে জুয়া খেলতে দেখেছেন তিনি।
ধানমন্ডি ও কলাবাগান ক্লাবে ক্যাসিনো পরিচালনার বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মারুফ হোসেন সরদার বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত কারও কাছ থেকে এ ধরনের কোনো অভিযোগ পাইনি। ধানমন্ডি ও কলাবাগান ক্লাবে ক্যাসিনো চলে না।’
মতিঝিলের ভিক্টোরিয়া ক্লাবে জুয়া খেলেছেন এমন একজন জাগো নিউজকে বলেন, ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা করে সেখানে চিপস পাওয়া যায়। নগদ টাকা দিয়ে চিপস কিনে খেলতে হয়। শুধু জুয়া নয়, এখানে বিভিন্ন ধরনের মাদকেরও ব্যবস্থা আছে। অর্থের বিনিময়ে এখানে সবকিছু পাওয়া যায়।
অবৈধ ক্যাসিনোর বিষয়ে জাগো নিউজের পক্ষ থেকে ফুয়াং ও উত্তরা ক্লাব সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। তবে তাদের কেউই নিজেদের ক্লাবের বিষয়ে কথা বলার মতো দায়িত্বশীল ব্যক্তি নন বলে জানান।