পরিচালকদের অনৈতিক হস্তক্ষেপ, নজরদারি না থাকা এবং যাচাই-বাছাই ছাড়াই ব্যাংক ঋণ দেয়ার কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এর নেতিবাচক প্রভাব সরাসরি পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে এবং পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শেয়ারবাজার।
ব্যাংক ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে কঠোরতা ও নজরদারি বাড়ালে সার্বিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং প্রসারিত হবে দেশের শেয়ারবাজার- এমনটি মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও শেয়ারবাজার বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, ব্যাংক কোম্পানিগুলোতে পরিচালকদের এক ধরনের দৌরাত্ম্য চলছে। পরিচালকরা এতোটাই প্রভাবশালী তারা কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করছেন না। তাদের প্রভাবের কারণেই ব্যাংকগুলো যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ দিচ্ছে। যে কারণে প্রতিনিয়ত ঋণ খেলাপি অর্থের পরিমাণ বাড়ছে।
তাদের মতে, ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে নিয়ম করা যেতে পারে। কোনো প্রতিষ্ঠান বড় অংকের ঋণ নিতে চাইলে সেই প্রতিষ্ঠানকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হতে হবে। বড় অংকের ঋণের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তি বাধ্যতামূলক করা গেলে বাজারের প্রসার ঘটবে এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণও কমে আসবে। কী পরিমাণ ঋণের ওপর শেয়ারবাজারে কোনো প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্তি বাধ্যতামূলক করা হবে তা আলাপ-আলোচনা ও পর্যালোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হবে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছয় লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। আর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৩ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
গত বছরের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার ২৩৭ কোটি টাকা। আর এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। ২০১৬ সালের মার্চ প্রান্তিক শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে রাষ্ট্রীয় খাতের সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৫ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা, যা গত বছরের ডিসেম্বর প্রান্তিকের থেকে চার হাজার ৬৯১ কোটি টাকা বেশি।
বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ডিসেম্বরের তুলনায় মার্চে ছয় হাজার ৬৭০ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকের পর্ষদে একশ্রেণির পরিচালক রয়েছেন, যারা নিজের ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকের পরিচালককে অনৈতিকভাবে ঋণ দেন এবং নিজে অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেন। আবার রাজনৈতিক প্রভাবেও কিছু ঋণ দেয়া হয়। ব্যাংকাররা যাচাই-বাছাই ছাড়াই ব্যাংক ঋণ অনুমোদন করেন। যে কারণে প্রতিনিয়ত বড় অংকের ঋণ খেলাপি হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে বড় বড় ঋণগ্রহীতার এক শ্রেণির মধ্যে ঋণ পরিশোধ না করার কালচার রয়ে গেছে। তাদের ধারণা, ঋণ পরিশোধ না করলে কিছুই হবে না। আইনের বাস্তবায়ন না থাকায় তাদের মধ্যে এ প্রবণতা দেখা দেয়। ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার পর তা পরিশোধ না করার এ রীতি বন্ধ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, এখন ব্যাংক ঋণের সুদের হার যথেষ্ট কম এবং সহজে ঋণ পাওয়া যায়। তবে নতুন শিল্পায়নের জন্য কোম্পানির শেয়ারবাজারে আসলে ভালো হয়। প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে ভালো ভালো কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে আনার চেষ্টা করতে হবে। ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো যদি কঠোর হয়, তাহলে আশা করা যায় শেয়ারবাজারে আইপিও আসার পরিমাণ বাড়েবে। এতে শেয়াবাজারের প্রসার ঘটবে এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে আসবে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের দেশে অনেকের টেন্ডেন্সি (মনোভাব) হলো পুঁজিবাজারে না আসা। কারণ ব্যাংক ঋণ সহজে পাওয়া যাচ্ছে। আবার ব্যাংক ঋণের সুদের হার এখন অনেক কমে গেছে। এতে আইপিওতে না এসে ব্যাংক ঋণ নেয়ার আগ্রহ বেড়ে গেছে। ব্যাংক ঋণের নির্ভরতা কমিয়ে, শেয়ারবাজার থেকে নতুন নতুন কোম্পানির অর্থ উত্তোলনের পরিমাণ বাড়লে বাজার প্রসারিত হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড পাবলিক পলিসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, শেয়াবাজারে তালিকাভুক্ত না এমন প্রতিষ্ঠানকে বড় অংকের ব্যাংক ঋণ দেয়া যাবে না- এমন নিয়ম করা গেলে, সেটি খুবই ভালো পদক্ষেপ হবে। এর পাশাপাশি পর্ষদে যারা দৌরাত্ম্য করছেন তাদের ক্ষমতা খর্ব করতে হবে। তাহলে ব্যাংক ভিত্তিক শিল্পায়ন কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে এবং শেয়ারবাজারের মাধ্যমে মূলধন সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু হবে।
তিনি বলেন, ব্যাংক কোম্পানির পরিচালকদের দৌরাত্ম্য এতোটাই যে এখানে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তারা (পরিচালকরা) এতোটাই প্রভাশালী যে, যা চায় তা-ই তারা করতে পারে। ব্যাংক খাতে এখন হাজার হাজার কোটি টাকার প্রবলেম লোন সৃষ্টি হয়েছে। তারা তো সাধারণ মানুষ না। তারা ওই সম্পদ নিয়ে বিনিয়োগ করেনি, উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ায়নি। তারা এটা লুণ্ঠন করেছে, মানিলন্ডারিং করেছে। এ জায়গাগুলোতে যদি ব্যাপক সুশাসন ফিরিয়ে আনা যায়, তাহলে শেয়ারবাজারের পাশাপাশি আর্থিক খাতেও সুফল আসবে।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংক ভিত্তিক শিল্পে অর্থায়নের যে প্রাকটিস চালু আছে এবং খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে সরকারের যে প্রাকটিস আছে, তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে শেয়ারবাজারে এর ব্যাপক পজিটিভ ইমপ্যাক্ট (প্রভাব) দেখা দেবে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, আমাদের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা অনেক কম। বাংলাদেশে যে পরিমাণ লিমিটেড কোম্পানি আছে, সে হিসেবে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা এতো কম হওয়া ঠিক না। তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা বাড়ানোর জন্য ব্যাংক ঋণের বিষয়ে কিছু বাধা সৃষ্টি করা যেতে পারে। যেমন- একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অংকের বেশি ঋণ নিতে চাইলে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া বাধ্যতামূলক করার রীতি করা যেতে পারে। ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে এ নিয়ম করা গেলে শেয়ারবাজারে ব্যাপক অংশগ্রহণ হবে। এতে শেয়ারবাজারের প্রসার ঘটবে এবং সার্বিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।