প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মাঠ পর্যায়ে সাফল্য এবং প্রশিক্ষণে দক্ষতাই সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের পদোন্নতির জন্য সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মানদন্ড হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব ভবিষ্যতে জাতির উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের কথা চিন্তা করে এবং গণতন্ত্রকে সুসংহতকরণে দক্ষ এমন দেশ প্রেমিক কর্মকর্তাদের হাতে থাকা উচিত।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আশা প্রকাশ করি যে, জাতির উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ আরো উত্তোরত্তর বৃদ্ধি পাবে।… দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অগ্রযাত্রায় তাদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। কাজেই এ কথা মাথায় রেখেই ভবিষ্যতে দক্ষ এবং দেশপ্রেমিক কর্মকর্তাদের কাছেই নেতৃত্বের দায়িত্ব অর্পণ করা উচিত।’
শেখ হাসিনা গতকাল ঢাকা সেনানিবাসস্থ সেনা সদর দপ্তরে আর্মি সিলেকশন বোর্ড-২০১৭’র বৈঠকে একথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্বে থাকা শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদেও নেতৃত্ব গ্রহনে ক্ষেত্রে চারটি বিশেষ গুণ থাকতে হবে। যেগুলো হচ্ছে-একজন কমান্ডার, কর্মকর্তা এবং প্রশিক্ষক হবার জন্য প্রথমত, সেনা কর্মকর্তাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর দৃঢ় আস্থা ও বিশ্বাস থাকতে হবে। দ্বিত্বীয়ত, তাদেরকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। দেশ ও সমাজের সেবার মানসিকতা এবং উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হতে হবে।
তৃতীয়ত, তাদের মাঠ পর্যায়ের সাফল্য থাকতে হবে।
এবং চতুর্থত, তাদের অবশ্যই নেতৃত্বের যোগ্যতা, পেশাগত এক্সিলেন্স, নিয়মানুবর্তিতা, সততা এবং নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য থাকতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটি গণতন্ত্রিক দেশে সেনবাহিনীর খুব গুরত্বিপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সুষম করতে তারা গুরুত্বপূর্ণ সহযোগীর ভূমিকা পালন করতে পারে। কাজেই সেনাবাহিনীতে তাদের কাছেই নেতৃত্বের দায়িত্ব অর্পণ করা উচিত-যারা সুশিক্ষায় শিক্ষিত, প্রতিযোগিতায় দক্ষ, মেধাবী এবং সর্বোপরি গণতন্ত্রের প্রতি পুরোপুরি শ্রদ্ধাশীল।
তিনি এ সময় কর্মকর্তাদের পদোন্নতির জন্য সিলেকশন বোর্ডকেও যোগ্যতার এই মাপকাঠি বিবেচনায় আনার আহবান জানান।
প্রধানমন্ত্রী পদোন্নতির জন্য সেনা কর্মকর্তা নির্বাচনে ট্রেস (টিআরএসিই- টেবুলেটেড রেকর্ড এন্ড কম্পারেটিভ ইভালুয়েশন) পদ্ধতির অন্তর্ভুক্তিতে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
প্রধানমন্ত্রীর সিলেকশন বোর্ডের সদস্যদের প্রতি তাঁর দৃঢ় আস্থা ও বিশ্বাস থাকার উল্লেখ করে বলেন, তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন-সিলেকশন বোর্ডের সদস্যরা সকল ব্যক্তিগত পছন্দ, অপছন্দের উর্ধ্বে উঠে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আস্থাশীল, দক্ষ এবং দেশপ্রেমিক কর্মকর্তাদেরই পদোন্নতির জন্য নির্বাচন করবেন।
এ সময় প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সেনা প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মুহম্মদ শফিউল হক, মুখ্য সচিব ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী, প্রতিরক্ষা সচিব আখতার হোসেন ভূইয়া এবং প্রেস সচিব ইহসানুল করিম উপস্থিত ছিলেন।
সেনা সদস্যদের জাতীয় কর্মকান্ডে অংশ গ্রহণের প্রসংগ উল্লেখ করে এ ধরনের কর্মকান্ড ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকার আশাবাদ ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগে সেনাবাহিনীর সদস্যরা যেভাবে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য ও সহমর্মিতা প্রদর্শন করেছে তা জনগণের প্রভূত প্রশংসা ও বিশ্বব্যাপী সুনাম অর্জন করেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে সেনাসদস্যরা দ্রুত গতিতে সাড়া দিয়ে সাধারণ জনগণের পাশে দাঁড়ানোর ফলে সেনাবাহিনীর উপর জনগনের আস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি বলেন, সম্প্রতি রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে পাহাড় ধ্বসে সমগ্র এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে নিরলস প্রচেষ্টায় তা দ্রুত পুনরুদ্ধার অভিযান ও পাহাড় ধ্বসে ক্ষতিগ্রস্তদের খাবার, পানি ও চিকিৎসাসেবা প্রদানসহ সাতটি আশ্রয় কেন্দ্রের এর দায়িত্ব গ্রহণ করে জনগণের সেবায় সেনাসদস্যরা নিজেদের নিয়োজিত করেন।
সেনাসদস্যদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন,রাঙ্গামাটিতে উদ্ধার কার্যক্রম চলাকালীন দুই জন সেনা কর্মকর্তাসহ পাঁচজন সহকর্মীকে হারানোর ব্যথা নিয়ে রোজা রেখে আর্তমানবতার সেবায় আপনাদের এই আত্মত্যাগ একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আমি সেনাবাহিনীর সদস্যদের আত্মত্যাগকে গভীর সমবেদনার সাথে স¥রণ করছি।
তিনি বলেন, জাতির পিতার প্রণীত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের ধারাবাহিকতা আমাদের সরকার ১৯৯৬ হতে ২০০১ সাল পর্যন্তও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যাপক উন্নতি-অগ্রগতি সাধন করেছিল।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণের মান আধুনিক ও যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে তাঁর সরকার কয়েকটি নতুন প্রশিক্ষণ একাডেমীসহ সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পদাতিক কোরের উন্নয়ন ও কার্যক্রমে গতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টাল সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়। এছাড়াও সেনাসদস্যদের চিকিৎসা, বেতন ভাতা ও আবাসনসহ বিভিন্ন উন্নয়ন ও পুনর্গঠনমূলক পদক্ষেপ গৃহীত হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০০৯ সাল হতে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সেনাবাহিনীর উন্নয়নের লক্ষ্যে নতুন পদাতিক ডিভিশন ও ব্রিগেড প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও সরঞ্জামাদিতে সজ্জিত করার বিভিন্ন বাস্তবমুখী পদক্ষেপ অব্যাহত ছিল।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১১ই জানুয়ারী বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির প্রথম শর্ট কোর্সের সমাপনী কুচকাওয়াজে উন্নত বিশ্বের চৌকস সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ একাডেমীর সমতুল্য একটি একাডেমী প্রতিষ্ঠার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রশিক্ষণ একাডেমীগুলো আজ বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিচিত।
দেশ গঠনে সোনবাহিনীর গৌরবজ্জ্বল ভুমিকার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের নিরাপত্তা ও তদারকি, ‘পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প’ এর সুপারভিশন পরামর্শক হিসেবে ¯¦প্নের পদ্মা সেতু নির্মাণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নকল্পে আরও বেশ কয়েকটি প্রকল্প চলমান রয়েছে।
সরকার প্রধান বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিভিন্ন প্রতিকূলতায় থমকে যাওয়া মেরিন ড্রাইভ সড়কটি সকল প্রকার কারিগরি মান বজায় রেখে দেশজ স¤পদ এবং মেধা ব্যবহার করে নির্ধারিত সময়ের আগেই অত্যন্ত সফলতার সাথে স¤পন্ন করেছে। ৬ জন সেনাসদস্যের অমূল্য প্রাণের বিনিময়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সেনাবাহিনী তার পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছে।
সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনে সেনাবাহিনীর ভ’মিকার প্রসংগ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় ও জঙ্গি তৎপরতা দমনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরায় ও সিলেটের আতিয়া মহলে সেনাবাহিনীর কমান্ডো ইউনিটের জঙ্গিবিরোধী অভিযান দেশে ও বিদেশে সেনাবাহিনীর উন্নত প্রশিক্ষণ, দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছে। সেনাসদস্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে আতিয়া মহল থেকে ২১ জন শিশুসহ সর্বমোট ৭৮ জনকে নিরাপদে উদ্ধার করে। সফলভাবে এই দুটি জিম্মি উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করার জন্য আমি আপনাদেরকে আবারো আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেনাসদস্যদের মনোবল বৃদ্ধিতে বর্তমান সরকারের সময়ে বিভিন্ন ধরণের উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও কল্যাণমুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, আধুনিক বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন সেনানিবাসে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আধুনিক চিকিৎসা সুবিধাসহ ঢাকা সিএমএইচকে একটি আন্তর্জাতিক মানস¤পন্ন হাসপাতালে পরিণত করার পাশাপাশি বিভিন্ন সেনানিবাসে আর্মি মেডিক্যাল কলেজ, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজি এবং আর্মি স্কুল অব বিজনেস এন্ড এ্যাডমিনিস্ট্রেশন গঠন করা হয়েছে। এছাড়াও সেনাবাহিনীতে আরও ৫টি ডেন্টাল কলেজ এবং ৫টি নার্সিং ইনষ্টিটিউট স্থাপনের পরিকল্পনা প্রক্রিয়াধীন আছে। এর ফলে চিকিৎসা ও কারিগরি শিক্ষার মান বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। বাংলাদেশের একমাত্র বার্ন ইউনিট ও প্লাষ্টিক সার্জারি হাসপাতাল নির্মাণের কাজ সেনাবাহিনীকে অর্পন করা হয়েছে। যা দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যতম একটি হাসপাতাল হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, জন প্রসাশনের বেতন-ভাতাদি বৃদ্ধির দিকে নজর রেখেই সেনা সদসদের জন্য নতুন বেতন-ভাতার কাঠামো নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ সময় ‘জলসিঁড়ি’ আবাসন প্রকল্পের কাজও দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে বলে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী ৭ দশমিক ২ শতাংশ জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন সহ তাঁর সরকারের নেতৃত্বে দেশের সুষম আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের একটি খন্ডচিত্রও তুলে ধরে বলেন, তাঁর সরকারের এই মেয়াদেই একইসঙ্গে মুদ্রাস্ফীতি দুই অংকের সংখ্যা থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ফলে মানুষের গড় আয়ু বৃিদ্ধ পেয়ে বর্তমানে ৭২ বছরে উন্নীত হয়েছে।
বর্তমান সরকার নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সরকারই সর্বপ্রথম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মহিলা অফিসার এবং আর্মি মেডিকেল কোরে প্রথমবারের মত মহিলা সৈনিক অন্তর্র্ভুক্ত করে। এছাড়াও, বর্তমানে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন কোরে মহিলা সৈনিকরা অত্যন্ত সফলতার সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে জেনে আমি খুশি হয়েছি।
তিনি বলেন,আমি আরও খুশি হয়েছি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মহিলা অফিসারগণ স্টাফ কলেজ স¤পন্ন করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাচ্ছেন এবং ইতোমধ্যে ২ জন নারী অফিসার সেনা বিমানে পাইলট হিসাবে প্রশিক্ষিত হয়েছেন।
সরকার প্রধান বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক কঙ্গোতে প্রেরিত একটি মেডিকেল কন্টিনজেন্টের কন্টিনজেন্ট কমান্ডার হিসেবে মহিলা অফিসার এর সফল শান্তিরক্ষা কার্যক্রম জাতিসংঘ ও বিশ্বে নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়ে বাংলাদেশের উদ্যোগকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। এ সকল অর্জনগুলো নারীর ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়াকে আরো বেগবান করবে। ফলে সামগ্রিক আর্থ সামাজিক অবস্থার ব্যাপক উন্নতি হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।