মহাধসের ধকল অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে দেশের শেয়ারবাজার। প্রায় এক বছর ধরে মূল্য সূচক ও লেনদেন রয়েছে বেশ ইতিবাচক ধারায়। ফলে এর প্রভাব পড়েছে সরকারের রাজস্ব আদায়েও। অর্ধযুগ পর অর্থাৎ ২০১০-১১ অর্থবছরের পর সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে (২০১৬-১৭) শেয়ারবাজার থেকে সর্বোচ্চ রাজস্ব পেয়েছে সরকার।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে শেয়ারবাজার থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় ৪৩০ কোটি টাকা। ২০১০-১১ অর্থবছরের পর শেয়ারবাজার থেকে আর কখনও এত টাকার রাজস্ব আদায় হয়নি। ২০১০-১১ অর্থবছরে শেয়ারবাজার থেকে সরকার রাজস্ব আদায় করেছিল ৬২৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই), চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) এবং সেন্ট্রাল ডিপোজেটরি বাংলাদেশ (সিডিবিএল)- এই তিন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করে সরকার। বরাবরের মতো এবারও এই তিন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ডিএসইর মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে।
ডিএসইর মাধ্যমে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকার রাজস্ব আদায় করেছে ২৮২ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে লেনদেনের ভিত্তিতে ডিএসইর স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১৮০ কোটি ২৯ লাখ টাকা। বাকি অর্থের মধ্যে তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরা দিয়েছেন ৬৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা, লভ্যাংশ থেকে ৩৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা এবং স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্যদের শেয়ার হস্তান্তর থেকে আদায় হয়েছে এক কোটি তিন লাখ টাকা।
সিএসই থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে লেনদেনের ভিত্তিতে সিএসইর স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১১ কোটি ৮১ লাখ টাকা। বাকি অর্থের মধ্যে তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরা দিয়েছেন চার কোটি ১০ লাখ টাকা এবং লভ্যাংশ থেকে সাত কোটি ৩৬ লাখ টাকা রাজস্ব এসেছে।
অপর প্রতিষ্ঠান সিডিবিএল সরকারকে রাজস্ব দেয় বিনিয়োগকারীদের বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট (বিও হিসাব) এবং সিডিবিএল’র নিজস্ব কর্পোরেট ট্যাক্স- এই দুটির মাধ্যমে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিও হিসাব থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৬৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। আর সিডিবিএল’র দেয়া কর্পোরেট ট্যাক্সের সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এ খাত থেকে প্রায় ৬০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এক নজরে শেয়ারবাজার থেকে সরকারের রাজস্ব আদায়
খাত
২০১০-১১
২০১১-১২
২০১২-১৩
২০১৩-১৪
২০১৪-১৫
২০১৫-১৬
২০১৬-১৭
ডিএসই
৪৪৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা
২৭১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা
১২৭ কোটি ২৯ লাখ টাকা
১৫৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা
১৭৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা
১৯৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা
২৮২ কোটি ২৩ লাখ টাকা
সিএসই
৩৫ কোটি ৭ লাখ টাকা
২৫ কোটি ৯ লাখ টাকা
১২ কোটি ১৯ লাখ টাকা
১১ কোটি ৬ লাখ টাকা
১২ কোটি ১৩ লাখ টাকা
১০ কোটি ৪ লাখ টাকা
২৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা
সিডিবিএল
১৪৩ কোটি ৯ লাখ টাকা
১২৭ কোটি ৯৪ লাখ টাকা
৯৪ কোটি ৮২ লাখ টাকা
৯৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা
১৩১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা
১০৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা
প্রায় ১২৪ কোটি টাকা
মোট
৬২৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা
৪২৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা
২৩৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা
২৫৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা
৩১৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা
৩০৮ কোটি টাকা
প্রায় ৪৩০ কোটি টাকা
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘ মন্দার পর ২০১৬-১৭ অর্থবছরজুড়ে দেশের শেয়ারবাজারে চাঙাভাব ছিল। মূল্য সূচক ও লেনদেন উভয় বেড়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে। মূল্য সূচক, লেনদেন, বিদেশি বিনিয়োগ ও বাজার মূলধনে সৃষ্টি হয়েছে একের পর এক রেকর্ড। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে সরকারের রাজস্ব আদায়ে।
তারা বলছেন, শেয়ারবাজার চাঙা হলে সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। আর এই বাজার চাঙা রাখতে ভালো ভালো কোম্পানি যেন এখানে আসে তার ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি করা যেতে পারে। যেনতেনভাবে ব্যাংক ঋণ না দিয়ে, ঋণ আদায় হবে- এমন ক্ষেত্রে ঋণ দেয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি একটি নির্দিষ্ট অংকের ওপরে ঋণ নিতে হলে পুঁজিবাজারে আসা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মার্কেটের পরিস্থিতি আগের অর্থবছরের তুলনায় অনেক ভালো। লেনদেন ও সূচক উভয়ই বেশ বেড়েছে। প্রধান সূচক বেড়েছে এক হাজার পয়েন্টের ওপরে। এটা ঠিক আছে। তবে নতুন শিল্পায়নের জন্য কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারে আসলে ভালো হয়। চেষ্টা করা উচিত নতুন ভালো কোম্পানি আইপিও’র মাধ্যমে বাজারে আনার। এতে বাজারের পরিধি বাড়বে, বিনিয়োগকারীরা উপকৃত হবেন এবং শেয়ারবাজার থেকে সরকারের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণও বাড়বে।
শেয়ারবাজারে নতুন কোম্পানি আনতে ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপের পরামর্শ দিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, আমাদের দেশে ব্যাংক ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করার এক ধরনের প্রবণতা রয়েছে। তাদের ধারণা, ঋণ শোধ করতে পারলে পারলাম, না পারলে না পারলাম। যে কারণে অনেকে ব্যাংক ঋণ পছন্দ করেন। ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার পর তা পরিশোধ না করার রীতি বন্ধ করতে হবে। ব্যাংক ঋণের বিষয়ে কঠোর হওয়া গেলে আশা করা যায় শেয়ারবাজারে আইপিও আসার পরিমাণ বাড়বে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড পাবলিক পলিসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পুঁজিবাজার থেকে সরকারের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে পজেটিভ বিষয়। শেয়ারবাজরকে যদি আরও উন্নত করা যেত, লেনদেনের পরিমাণ আরও বাড়াত। বাজারের উন্নয়ন যদি আরও করা যেত তাহলে সরকারের আয়ের সুযোগও সৃষ্টি হতো। এ জন্য শেয়ারবাজারের কাঠামোগত উন্নয়ন করে বন্ড মার্কেট, ডেরিভেটিভ মার্কেট চালু করতে হবে।
ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী জাগো নিউজকে বলেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে। নতুন বিনিয়োগকারীরা এসেছেন। গত পাঁচ বছরে অনেক কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে। মূলত এসব কারণে শেয়ারবাজার থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় বেড়েছে।
তিনি বলেন, শেয়ারবাজার যত জনপ্রিয় হবে এখান থেকে সরকারের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ তত বাড়বে। এখন দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন ব্যাংকের মাধ্যমে হয়। যে কারণে অনেক কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় না। যদি অন্য দেশের মতো ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা থাকে, যেমন- একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার ওপরে ঋণ নিতে হলে শেয়ারবাজারে আসতে হবে, তাহলে এখানে ব্যাপক অংশগ্রহণ হবে। এতে সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়বে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ডিএসইতে ২৩৯ কার্যদিবসে মোট এক লাখ ৮০ হাজার ৫২২ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। যা ২০১০-১১ অর্থবছরের পর সর্বোচ্চ। ২০১০-১১ অর্থবছরে ২৪০ কার্যদিবসে মোট লেনদেন হয় তিন লাখ ২৫ হাজার ৯১ কোটি টাকা। যা দেশের শেয়ারবজারের ইতিহাসে এক অর্থবছরে সর্বোচ্চ লেনদেন। এরপর একে একে ছয়টি অর্থবছর পার হলেও এক অর্থবছরের মোট লেনদেন আর দুই লাখ কোটি টাকার ঘরে পৌঁছাতে পারেনি।
মহাধসের পরের অর্থবছর ২০১১-১২ তে ডিএসইতে ২৩৮ কার্যদিবসে মোট লেনদেন হয় এক লাখ ১৭ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। পরের অর্থবছর ২০১২-১৩ তে ২৩৫ কার্যদিবসে মোট লেনদেন হয় ৮৫ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২৩৯ কার্যদিবসে লেনদেন হয় এক লাখ ১২ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা, ২০১৪-১৫ অর্থবছরের ২৩৮ কার্যদিবসে লেনদেন হয় এক লাখ ১২ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ২৪৭ কার্যদিবসে লেনদেন হয় এক লাখ ৭ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা।
সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে লেনদেনের পাশাপাশি বেড়েছে মূল্য সূচক এবং বাজার মূলধনের পরিমাণও। ডিএসইর প্রধান সূচক ডিসইএক্স চার হাজার ৫০৮ পয়েন্ট দিয়ে ২০১৬-১৭ অর্থবছর শুরু হয়। অর্থবছর শেষে যা দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৬৫৬ পয়েন্টে। অর্থাৎ এক অর্থবছরের ব্যবধানে ডিএসইর প্রধান সূচক বেড়েছে এক হাজার ১৪৮ পয়েন্ট। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম কার্যদিবসে ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল তিন লাখ ১৮ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। যা অর্থবছর শেষে দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৮০ হাজার ১০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাজার মূলধন বেড়েছে ৬১ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা।