চাচাতো বোনের ফোন পেয়ে তখন সবেমাত্র ওই টাওয়ার ভবনের নিচে গাড়ি নিয়ে পৌঁছেছি। কয়েক মিনিট বাদেই দেখি আঠারো তলার ফ্ল্যাটের জানালা খুলে চাচা পরিত্রাহি চিৎকার করছেন আমাদের বাঁচাও, আমাদের বাঁচাও। আগুন আমাদের ফ্ল্যাটের ভেতর ঢুকে পড়ছে!
তার কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার চাচাতো বোন তানিমার ফোন এল, ওই শেষবারের মতো। বলল, আগুন পুরো ফ্ল্যাট ছেয়ে ফেলেছে – বাথরুমটা শুধু এখনও বাকি। আমরা সবাই মরে যাচ্ছি, শুধু দোয়া করবেন যেন বেশি কষ্ট না-পেয়ে মরি!
ব্যাস – আর কোনও কথা বলতে পারিনি। আমার দুচোখ পানিতে ভিজে এল। তারপর যতবারই তানিমার নম্বর মিলিয়েছি, সেই কল শুধু বারবার ভয়েস মেলেই গেছে।
লন্ডনের লাটিমার রোডের কাছে গ্রেনফেল টাওয়ারের ভয়াবহ আগুনে স্বজনদের হারানো কেনসিংটনের আবদুর রহিম এভাবেই বিবিসির মানসী বড়ুয়ার কাছে বর্ণনা করছিলেন কীভাবে ভয়াবহ আগুন গ্রাস করে নিয়েছে তার চাচা কমরু মিঞার পরিবারকে।
ওই বহুতলের আঠারো তলার একটি ফ্ল্যাটে দশ-বারোমাস আগে সাময়িকভাবে এডমন্টন থেকে সরিয়ে আনা হয়েছিল বাংলাদেশি ওই পরিবারটিকে।
প্রায় নব্বই কমরু মিঞার অত ওপরে চলাফেরায় কষ্ট হত, তিনি আর্জিও জানিয়েছিলেন নিচের তলার কোনও ফ্ল্যাটে তাদের সরিয়ে নিতে।
তার ভাতিজা আবদুর রহিমের ভাষ্য অনুযায়ী, তার আবেদনে ‘দেখছি, দেখছি’ বললেও কর্তৃপক্ষ শেষমেশ কিছুই করেনি। হয়তো নিচের কোনও ফ্ল্যাটে থাকলে তারা বেঁচেও যেতে পারতেন, এই ভাবনাটাই এখন কুরে কুরে খাচ্ছে আবদুর রহিমকে। তবে তাঁকে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছে চাচাতো বোনটার বিয়ের স্বপ্ন চুরমার হয়ে যাওয়াটা।
জুলাইয়ের ২৯ তারিখ তানিমার বিয়ের সব ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছিল। ওর ভাল নাম হুসনা বেগম, তবে আমরা আদর করে সবাই তানিমা বলেই ডাকতাম। পড়াশুনো করত, সঙ্গে একটা মোবাইল ফোন কোম্পানিতে পার্টটাইম কাজও করত বাইশ বছরের মেয়েটা।
বিয়ের জন্য হল-টলও সব বুক করা হয়ে গিয়েছিল। পাত্র ছিল লেস্টারের – খুব ভাল ছেলে পেয়েছিলাম আমরা। বিয়ে নিয়ে গত কয়েকদিন তানিমার সঙ্গে আমাদের কত ঠাট্টা মশকরাও হয়েছে।
আগুন লাগার খবর পেয়ে সেই ছেলেও মাত্র দেড় ঘন্টার মধ্যে লেস্টার থেকে ড্রাইভ করে চলে এসেছিল লন্ডনে। বুধবার সারাদিন ধরে আমরা এই হাসপাতাল, ওই হাসপাতাল খুঁজে বেড়িয়েছি যদি তানিমাদের কোনও খবর মেলে। ছেলেটাও ভীষণ ভেঙে পড়েছে, জানেন!
এত সুন্দর একটা সম্পর্ক তৈরি হওয়ার আগেই এমন করুণ পরিণতির মধ্যে দিয়ে শেষ হয়ে গেল – এটা ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলেন কেনসিংটনের বাসিন্দা আবদুর রহিম। আবারও গলা ভারি হয়ে আসে।
বুধবার মধ্যরাতের পর ঠিক রাত ১টা ৩৭ মিনিটে চাচাতো বোন তানিমার ফোনেই ধড়ফড় করে ঘুম থেকে ওঠেন তিনি। আমাদের বিল্ডিংয়ে আগুন লেগেছে। আমরা বেরোতে পারছি না, কোন রাস্তায় যাব বুঝতে পারছি না। আপনে জলদি আসেন, মেয়েটা ভয়ার্ত গলায় বলেছিল তাকে।
আমি যখন গ্রেনফেল টাওয়ারের দিকে ড্রাইভ করছি, তখনও ব্লু-টুথ দিয়ে ফোনে ওকে বলছিলাম সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামো তোমরা। তানিমা খালি তখন বলল ধোঁয়ায় সব অন্ধকার – কিছুই ওরা দেখতে পাচ্ছে না!
আবদুর রহিম ঊর্ধ্বশ্বাসে গাড়ি চালিয়ে সেখানে গিয়েও চাচার পরিবারকে বাঁচানোর জন্য শেষ পর্যন্ত কিছুই করতে পারেননি। অসহায়ভাবে তাঁকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়েছে আগুন কীভাবে গ্রাস করে নিয়েছে ওই মানুষগুলোকে।
রাগে-দু:খে তার মনে হচ্ছে, দমকল বিভাগও হয়তো টাওয়ারের ওপরতলার বাসিন্দাদের বাঁচানোর জন্য যথেষ্ট তৎপরতা দেখায়নি।
আর এই প্রবল শোকের মধ্যেও আবদুর রহিমের চোখে বারবার ভেসে উঠছে আদরের বোন তানিমার মুখটা – মাত্র দেড় মাস বাদেই যাকে কনের সাজে দেখার জন্য তারা সবাই অপেক্ষা করে ছিলেন। সূত্র: বিবিসি বাংলা।