সর্বাধিক পাঁচবারের বিশ্বকাপ জয়ী ও ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দুইবারের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া আর ওয়ানডে র্যাংকিংয়ের এক নম্বর দল দক্ষিণ আফ্রিকা নেই। গ্রুপ পর্বেই ছিটকে পড়েছে। সেখানে সেমিফাইনালে বাংলাদেশ! ‘এটা কিছু হলো। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি আকর্ষণ হারাল। উত্তেজনা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা কমল বহুগুণে।’
সমালোচকরা ভ্রূকুটি করছেন। তির্যক কথাবার্তাও হচ্ছে কিছু। অস্ট্রেলিয়া প্রকৃতির বৈরী আচরণের শিকার হয়ে বিদায় নিয়েছে। এমন কথাবার্তাও শোনা যাচ্ছে। যেহেতু অসিদের দুটি ম্যাচ বৃষ্টিতে ধুয়ে মুছে গেছে, তাই এমন কথা উঠতেই পারে। তাই বলে বাংলাদেশের উত্থান ও শেষ চারে জায়গা করে নেয়াকে খাতো করে দেখার কিছুই নেই।
পশ্চিমা প্রচার মাধ্যম যাই বলুক, কিছু নাক উঁচু পণ্ডিত, বোদ্ধা, বিশেষজ্ঞ-বিশ্লেষক যত কটূক্তিই করুন না কেন, বাংলাদেশ এমনি এমনি এতদূর উঠে আসেনি। নিজ যোগ্যতায় সেমিতে মাশরাফি, তামিম, মুশফিক, সাকিব ও মাহমুদউল্লহরা।
হ্যাঁ, এটা সত্য যে, ১১ বছর পর (২০০৬ সালের পর) চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলতে গিয়ে এবার অস্ট্রেলিয়ার সাথে দ্বিতীয় খেলায় প্রকৃতির সাহায্য পেয়েছে মাশরাফির দল। ক্রিকেটে যদিও শেষ বলে কিছু নেই। সব সম্ভব আর অসম্ভবের খেলা। তারপরও গত ৫ জুন অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ১৮২ রানের মামুলি সংগ্রহে অলআউট হওয়ার পর হারের সম্ভাবনাই ছিল বেশি।
কারণ পাল্টা ব্যাটিংয়ে নেমে অজিরা এক উইকেটে ৮৩ রান তুলে ফেলেছিল মাত্র ১৬ ওভারে। সৌভাগ্য টাইগারদের। আর চার ওভার খেলা হলেই ডি/এল পদ্ধতি বা বৃষ্টি আইনে অবধারিতভাবে হারতে হতো বাংলাদেশকে। অস্বীকার করার কোনোই উপায় নেই যে, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ম্যাচে বৃষ্টির বদান্যতায় এক পয়েন্ট পেয়েছে বাংলাদেশ। শেষ পর্যন্ত ওই পয়েন্টটাই কাজে দিয়েছে। না হয় নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে অবিস্মরণীয় জয়ের পরও সেমিতে খেলা হতো না বাংলাদেশের, যদি অস্ট্রেলিয়া সঙ্গে বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত ম্যাচের এক পয়েন্ট যোগ না হতো।
তারপরও নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে অনানুষ্ঠানিক কোয়ার্টার ফাইনালের জয়টি অনেক বড়। ম্যাচ কন্ডিশন তথা পরিবেশ, পরিস্থিতিকে মানদণ্ড ধরলে অনেক বড় অর্জন। বিশাল প্রাপ্তি। অনন্য অসাধারণ কৃতিত্ব। হয়তো বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে লড়িয়ে ও সংগ্রামী জয়ও। ২৬৫ রানের পিছু ধেয়ে ৩৩ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে বসা। তারপর সাকিব আল হাসান ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের জুটির রেকর্ড ২২৪ রান এবং জোড়া শতকে ৫ উইকেট হাতে রেখে ১৬ বল আগে জয়ের বন্দরে পৌঁছে যাওয়া সত্যিই অনেক কিছু।
ঐ অবিস্মরণীয় জয়ে প্রশংসার জোয়ারে ভাসছে এখন মাশরাফির দল। সাকিব আল হাসান ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ এখন জাতীয় বীর। তাদের বুক চিতানো ব্যাটিং আর ধ্বংস্তূপের মাঝে দাঁড়িয়েও ম্যাচ জেতানোর প্রশংসা সবার মুখে মুখে। কিন্তু তারপরও একটা পক্ষ বাংলাদেশের প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল খেলাকে ঠিক মেনে নিতে পারছেন না। তারা টাইগারদের এ উত্থানকে বলছেন ‘ফ্লুক বা অঘটন।’
কিন্তু আসলে কি তাই? হ্যাঁ এটা সত্যি যে, বাংলাদেশ এবারই প্রথম আইসিসির কোন মেগা বা বিশ্ব ইভেন্টে প্রথমবার সেমিফাইনাল খেলছে। কিন্তু টাইগারদের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল পর্যন্ত উঠে আসা কোনোভাবেই অঘটন বা ফ্লুক নয়। টাইগারদের গত এক যুগের পারফরম্যান্সকে পাখির চোখে পরখ করলে দেখা যাবে সাফল্যের সিঁড়ি বেঁয়েই এত ওপরে বাংলাদেশ।
‘সেটা কীভাবে? যত কঠিন, সংগ্রামী, লড়িয়ে আর অবিস্মরণীয় জয়ই হোক না কেন? এক নিউজিল্যান্ডকে হারানো মানেই সাফল্যের সিড়ি বেঁয়ে ওপরে ওঠা’ কেউ কেউ হয়তো অমনই ভাবছেন। আসলে মোটেও তা নয়। বাংলাদেশের ওপরে উঠে আসা বলতে শুধু ৯ জুন কার্ডিফে কিউইদের বিরুদ্ধে অনন্য জয়কেই ধরা হয়নি। বরং একটু খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বাংলাদেশ গত ১০-১২ বছর ধরেই উন্নতি করেছে। সেটা যে খুব চোখে পড়ার মত, তা নয়।
তবে একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে টাইগারদের পারফরম্যান্সের গ্রাফ খুব সোজা না হলেও ওপরের দিকেই আছে। সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে টাইগারদের ওপরে ওঠার গল্পর শুরু আজ থেকে ১১ বছর আগে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ২০০৭ সালের ১৭ মার্চ। বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বে সৌরভ গাঙ্গুলির ভারতকে ৫ উইকেটে হারিয়ে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল বাংলাদেশ। পেসার মাশরাফি (৪/৩৮) আর দুই বাঁহাতি স্পিনার মোহাম্মদ রফিক (৩/৩৫) আর আব্দুর রাজ্জাকের (৩/৩৮) বিধ্বংসী বোলিংয়ে মাত্র ১৯১ রানে আটকে রেখে তিন তরুণ তুর্কি তামিম (৫৩ বলে ৫১), মুশফিক (১০৭ বলে ৫৬) আর সাকিবের (৮৬ বলে ৫৩) হাফ সেঞ্চুরিতে বিশ্বকাপে প্রথমবার মহাপরাক্রমশালী ভারতকে বধ করে।
ওই অবিস্মরণীয় ও ঐতিহাসিক বড় জয়েই নিশ্চিত হয় সুপার এইটে খেলার টিকিট। সেরা আটের লড়াইয়ে আরেক চমক! এবার টাইগারদের দুর্দান্ত টিম পারফরম্যান্সের কাছে হার মানে ক্রিকেটের আরেক পরাশক্তি দক্ষিণ আফ্রিকা। মোহাম্মদ আশরাফুল (৮৩ বলে ৮৭) আর তামিম ইকবাল (৫৯ বলে ৩৮) ও আফতাব আহমেদের (৪৩ বলে ৩৫) দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে ২৫১ রানের লড়িয়ে পুঁজি গড়ে ওঠে। তার সঙ্গে বাঁহাতি পেসার সৈয়দ রাসেল (২/৪১) আর তিন বাঁহাতি স্পিনার রাজ্জাক (৩/২৫), সাকিব (২/৪৯) ও রফিক (১/২২) সাঁড়াশি বোলিংয়ে ৬৭ রানের ঐতিহাসিক জয়।
চার বছর পর উপমহাদেশে হওয়া বিশ্বকাপে সুপার এইটে যেতে না পারলেও ইংল্যান্ডকে হারিয়ে আবার নিজেদের সামর্থে্যর প্রমাণ দেয় টাইগাররা। ২০১১ সালের ১১ মার্চ চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে নবম উইকেটে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ আর পেসার শফিউলের অনমনীয় দৃঢ়তায় ইংলিশদের বিরুদ্ধে ২ উইকেটের কৃতিত্বপূর্ণ জয়ের দেখা পায় বাংলাদেশ।
এরপর ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মাটিতে বিশ্বকাপের পরের আসরে সাফল্যের তরী আরও এগিয়ে গেল। সেবার নিউজিল্যান্ডের মাটিতে প্রথমবারের মত কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার অধরা কৃতিত্ব দেখালো মাশরাফির বাংলাদেশ।
গ্রুপ ম্যাচে আইসিসি সহযোগী সদস্য আফগানিস্তান আর স্কটল্যান্ডের সঙ্গে জয়ের পর ২০১৫ সালের ৯ মার্চ অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে ইংলিশদের বিরুদ্ধে টিম পারফরমেন্সের এক অনুপম প্রদর্শনী ঘটিয়ে ১৫ রানের দারুণ এক জয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করে বাংলাদেশ।
সাফল্যের রথ থেমে থাকেনি সেখানেই। বিশ্বকাপের পর ঘরের মাঠে দূর্বার-দূর্মনীয় হয়ে ওঠে মাশরাফি, তামিম, মুশফিক, সৌম্য, সাকিব, মাহমুদউল্লাহ ও মোস্তাফিজরা। পাকিস্তানকে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ দিয়ে শুরু সাফল্যের নতুন পথে যাত্রা। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে নর্দাম্পটনে জয়ের পর যে দলের সঙ্গে জয় ছিল সোনার হরিণ, সেই পাকিস্তানিদের নাকানি চুবানি খাইয়ে যথাক্রমে ৭৯ রান, ৭ উইকেট আর ৮ উইকেটে অনায়াসে হেসে খেলে ধবলধোলাই করলো মাশরাফির দল।
এবারের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির মতই তামিম স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। তিন ম্যাচের প্রথম দুটিতে সেঞ্চুরি (১৩২ ও ১১৬) আর শেষ ম্যাচে আবার হাফ সেঞ্চুরি (৬৪) হাকিয়ে অমন নজর কাড়া সাফল্যে রাখলেন অগ্রণী ভূমিকা। সঙ্গে মুশফিকুর রহীম (১০৬ ও ৬৫) আর সৌম্য (শেষ ম্যাচে ১২৭) ব্যাট হাতে জ্বলে ওঠায় বিগ স্কোরিং গেমের সিরিজে সহজেই জয় দিল ধরা।
এরপর সাফল্যের মই বেঁয়ে আরও ওপরে ওঠা। প্রথমে ভারত, পরে দক্ষিণ আফ্রিকাকে সিরিজ হারানোর অধরা কৃতিত্ব। ২০১৫ সালের ১৮ ও ২১ জুন টাইগারদের ব্যাটিং ও বোলিংয়ের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে ব্যর্থ ভারত। বাঁহাতি কাটার মাস্টার মোস্তাফিজের অনন্য অসাধারণ বোলিংয়ে প্রথম দুই ম্যাচে খেই হারিয়ে ফেললো মহেন্দ্র সিং ধোনির ভারতীয় বাহিনী। তিন ম্যাচে (৫/৫০, ৬/৪৩ ও ২/৫৭ ) ১৩ উইকেট দখল করে ভারতীয় মাস্টার ব্যাটসম্যানদের নাভিশ্বাষ তুলে ছাড়েন মোস্তাফিজ। সঙ্গে ব্যাট হাতে নজর কাড়লেন তামিম, সৌম্য, মুশফিক, সাকিব, মাহমুদউল্লাহও। শেরে বাংলায় প্রথম ম্যাচে ৭৯ রানের জয় দিয়ে শুরু সিরিজ। একই ভেন্যুতে পরের ম্যাচে ৬ উইকেটের জয়ে ধরা দিল ভারতকে প্রথমবার সিরিজ হারানোর অধরা সাফল্য।
এখানেই শেষ নয় আরও আছে। ঠিক পরের মাসেই দক্ষিণ আফ্রিকা বধ। এবার একটু অন্য ভাবে আগানো। ২০১৫ সালের ১০ জুলাই শেরে বাংলায় প্রথম ম্যাচে দাঁড়াতে না পেরে ৮ উইকেটে হেরে যাওয়া। কিন্তু সেই হারকে শক্তিতে পরিণত করে পরে ম্যাচেই ঘুড়ে দাঁড়ানো। প্রথমে শেরে বাংলায় ৭ উইকেটে জিতে সিরিজে ফেরা। তারপর চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে সিরিজ নির্ধারণই ম্যাচে সৌম্য (৭৫ বলে ৯০) ও তামিমের (৭৭ বলে ৬১) উত্তাল উইলোবাজিতে ৯ উইকেটের জয়ে ২-১ এ সিরিজ জিতে যাওয়া।
তারপর ২০১৬ সালে ভারতের মাটিতে ব্যাঙ্গালোরে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতকে ১৪৫ রানে থামিয়ে খুব সহজে জয়ের কাছাকাছি পৌঁছেও শেষ পর্যন্ত ১ রানে হারলেও শক্তি ও সামর্থ্যের প্রমাণ দেয়া। এরপর গত বছরের ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে গিয়ে তিন ম্যাচের সিরিজে পর্যদুস্ত হলেও দুই মাস পর শ্রীলঙ্কায় গিয়ে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ ১-১ (একটি ম্যাচ বৃষ্টিতে পণ্ড) আর টি-টোয়েন্টি সিরিজও ১-১ অমীমাংসিত রেখে দেশে ফেরা।
এবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলতে যাবার আগে আয়ারল্যান্ডের মাটিতে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে আবার সামর্থ্যে প্রমাণ রাখা। ২৪ মে ডাবলিনে কিউইদের ৫ উইকেটে হারানোর পর ৯ জুন কার্ডিফে আবার একই ব্যবধানে জয়। ওপরের এই ইতিহাস ও পরিসংখ্যান পরিষ্কার বলে দিচ্ছে গত ১১ বছর বাংলাদেশ সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠেছে। তারই ধারাবাহিকতায় এবারের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির শেষ চার দলে জায়গা করে নেয়া।
নিজ চোখেই দেখলেন তো, সর্বশেষ তিন বিশ্বকাপের দুটিতে সেরা আটে ছিল বাংলাদেশ। তারপর গত দুই বছরের মধ্যে পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মত পরাশক্তি ও বড় দল হালে পানি পায়নি টাইগারদের সঙ্গে। সিরিজ হেরেছে। শ্রীলঙ্কার মাটিতে লঙ্কানদের সঙ্গে সিরিজ অমিমাংসিত রেখেছে মাশরাফির দল। আর কিউইদের বিপক্ষে ১৫ দিন আগে ডাবলিনে জেতার পর এবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে আবার ৫ উইকেটে হারিয়েছে টাইগাররা। আর সেই দলের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিতে খেলা কি ফ্লুক?
অতি বড় বাংলাদেশ বিরোধীও যে তা বলতে গিয়ে মুখ কাপবে। তার মানে গল্পটা সাজানো-গোছানো। কোন রকম অঘটন ঘটিয়ে কিংবা হঠাৎ আলোর ঝলকানি দিয়ে নয়, সাফল্যের সিড়ি বেঁয়েই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির শেষ চারে জায়গা করে নিয়েছে মাশরাফির দল।