বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নেয়া টাকা বাংলাদেশ ব্যাংককে ফেরত দিতে আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়েছে। বুধবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ৮৯ পৃষ্টার এ রায় প্রকাশ করা হয়।
এর আগে গত ১৬ মার্চ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নেয়া টাকা বাংলাদেশ ব্যাংককে ফেরত দিতে রায় ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের বিচারপতির আপিল বিভাগের বেঞ্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের করা আপিল খারিজ করে এ রায় ঘোষণা করেন।
আদালতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীদের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, অ্যাডভোকেট আহসানুল করিম ও খায়রুল আলম চৌধুরী। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার এম আমিরুল ইসলাম।
পরে আইনজীবী আহসানুল করিম বলেন, যারা টাকা ফেরত চেয়ে আদালতের দারস্থ হয়েছেন প্রথমে তারাই এ সুবিধা পাবেন। অন্যদের টাকা ফেরত পেতে আদালতে আবেদন করতে হবে।
ব্যারিস্টার এম আমিরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের জনগণ, আইন ও সংবিধান কখনও দুনীর্তিকে প্রশ্রয় দেয় না। এ রায় ইতিহাসে নিশ্চয় পুর্নবিবেচিত হবে।
আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউয়ের বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছেন এই সিনিয়র আইনজীবী।
মামলার বিবরণে জানা যায়, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছ থেকে জরিমানার অর্থ সংগ্রহ করা হয়। ২০০৭ সালের ১৯ এপ্রিল জেমস ফিনলের কাছ থেকে আদায় করে ১১৭ কোটি ৪১ লাখ টাকা। ওই টাকার ১৬ টি পে-অর্ডার বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারের কনসোলিটেড ফান্ডে প্রথম জমা দেয়া হয়।
এরপর ২২ এপ্রিল একই প্রতিষ্ঠানের নামে ১৫ টি পে-অর্ডারের মাধ্যমে আরও ১২০ কোটি ২৪ লাখ টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হয়। একই প্রক্রিয়ায় পর্যায়ক্রমে দেড় বছর ধরে বিভিন্ন তারিখে বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারের সংশ্লিষ্ট হিসাবে টাকা জমা হয়েছে।
ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পরিচয় ছাড়াও ‘অজানা’ উল্লেখ করেও চার দফায় প্রায় ৪৭ কোটি টাকা জমা দিয়েছেন কেউ কেউ। দেশের শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপের কাছ থেকে কয়েক দফায় বিপুল পরিমাণ টাকা আদায় করা হয়েছে ওই সময়।
২০০৭ সালের ২৮ মে থেকে ২০০৮ সালের ১১ জুন পর্যন্ত বসুন্ধরা গ্রুপের কাছ থেকে ২৫৬ কোটি টাকা নেয়া হয়। ২০০৭ সালের ১৯ জুন থেকে একই বছরের ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত মিসেস পারভীন হক সিকদার বাধ্য হয়ে সিকদার গ্রুপের পরিচালক ও সদস্যদের পক্ষ থেকে ৯টি পে-অর্ডারের মাধ্যমে মোট ৪২ কোটি টাকা পরিশোধ করেন বলে জানা গেছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আরও যাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়েছে এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো হলো— যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুলের ৩০ কোটি, এমজিএইচ গ্রুপ ২৪ কোটি, বিএনপির সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল ২০ কোটি, কবির স্টিল সাত কোটি, ব্যবসায়ী নুর আলী ৪০ কোটি ৫০ লাখ, আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশন ৩২ কোটি ৫০ লাখ, সাগুফতা হাউজিং দুই কোটি ৫০ লাখ, হোসাফ গ্রুপ ১৫ কোটি, পারটেক্স গ্রুপ ১৫ কোটি, স্বদেশ প্রোপার্টিজ ৯ কোটি, ইসলাম গ্রুপ ৩৫ কোটি, কনকর্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ৮ কোটি, ব্যবসায়ী রেজাউল করিম ১৭ কোটি, আবু সুফিয়ান ১৪ কোটি, শওকত আলী চৌধুরী ৬ কোটি, আশিয়ান সিটি ১ কোটি, পিংক সিটি ৬ কোটি ৪১ লাখ, বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশন ১৯ কোটি ৪৫ লাখ, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর ১৫ কোটি, ওয়াকিল আহমেদ ১৬ কোটি, এবি ব্যাংক ফাউন্ডেশন ৩২ কোটি, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আল মামুন ২০ কোটি ৪১ লাখ, এলিট পেইন্ট ২৫ কোটি ৪৪ লাখ, এবি ব্যাংক ১৯০ কোটি, কনকর্ড রিয়েল এস্টেট ৭ কোটি, জনৈক মালিক চার কোটি এবং ব্যবসায়ী আবদুল আউয়াল মিন্টু ২ কোটি ২০ লাখ টাকা।
জনশক্তি রফতানিকারক ও ইউনিক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুর আলীর কাছ থেকে ৪০ কোটি ৫০ লাখ টাকা নেয়া হয়েছিল। পরবর্তীকালে এসব জরিমানার অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া হয়। যার পরিমাণ ছিল ১২শ’ কোটি টাকা।
পরে এসব অর্থ ফেরত চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে একাধিক প্রতিষ্ঠান। এসব রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট এস আলম গ্রুপের সাতটি প্রতিষ্ঠানকে ৬০ কোটি টাকা, দি কনসোলিডেটেড টি অ্যান্ড ল্যান্ডস কোম্পানি লিমিটেড এবং বারাউরা টি কোম্পানি লিমিটেডকে ২৩৭ কোটি ৬৫ লাখ, মেঘনা সিমেন্ট ইন্ড্রাস্ট্রিজকে ৫২ কোটি, বসুন্ধরা পেপার মিলস লিমিটেডকে ১৫ কোটি, ইউনিক ইস্টার্ন প্রাইভেট লিমিটেডকে ৯০ লাখ, ইউনিক সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজকে ৭০ লাখ, ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টকে ১৭ কোটি ৫৫ লাখ, বোরাক রিয়েল এস্টেট প্রাইভেট লিমিটেডকে ৭ কোটি ১০ লাখ, ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডকে ৩৫ কোটি এবং ইস্ট ওয়েস্ট প্রপার্টি ডেভেলপমেন্টের এক পরিচালককে ১৮৯ কোটি ও ইউনিক ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারের সত্ত্বাধিকারীকে ৬৫ লাখ টাকা ফেরত দেয়ার নির্দেশ দেন। এ অর্থের পরিমাণ ৬ শ’ ১৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।
বিভিন্ন সময়ে দেয়া হাইকোর্টের এ রায় স্থগিতের আবেদন জানান বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত হাইকোর্টের রায় স্থগিত করে দেন। পাশাপাশি রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল দায়ের করতে বলা হয়।
আপিল বিভাগ ২০১৫ সালের ৩ আগষ্ট লিভ টু আপিল মঞ্জুর করে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আপিলের অনুমতি দেন। পরে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গত ১৬ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের করা সেই আপিল খারিজ করে টাকা ফেরত দিতে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।