দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য ভিসা বন্ধ রেখেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। এরপরও দেশটি থেকে আসা রেমিট্যান্স প্রবাহ থেমে যায়নি।
মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও বাংলাদেশি শ্রমিকরা বিভিন্ন উপায়ে মালিকদের কাছ থেকে ভিসা সংগ্রহ করে দেশটিতে কাজ করে যাচ্ছেন। যা রেমিট্যান্স প্রবাহের গতি অব্যাহত রেখেছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশিদের কাজ করার এ আকুলতার সুযোগ নিয়ে ‘ভিসা ব্যবসা’ খুলে বসেছেন কিছু মালিক। তাদের কারণে প্রতারিত হয়ে শূন্য হাতে দেশে ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন অনেক হতভাগ্য বাংলাদেশি।
মালিকের মাধ্যমে প্রতারিত হয়ে ভিসা সংকটে পড়ে কারাভোগের পর দেশে ফেরা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবির কারাগারে জেল খেটে গত ২৩ এপ্রিল দেশে ফেরেন ৫৭ বাংলাদেশি।
তাদের একজন মঞ্জুর আহম্মদ। জাগো নিউজের কাছে তার দেয়া বর্ণনায় উঠে আসে হতভাগ্য বাংলাদেশিদের প্রতারিত হওয়ার গল্প।
মঞ্জুর জানান, ২০০৯ সালে একটি দোকানের চাকরি নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যান। কিন্তু সেখানে বেতন নিয়মিত না হওয়াসহ নানা ধরনের সমস্যা ছিল। একসময় তিনি দোকানের চাকরি ছেড়ে অন্য একটি কোম্পানির ভিসা সংগ্রহ করেন। তবে প্রথম মালিকের সঙ্গে চুক্তি ছিল, কোম্পানির ভিসা হলেও ইচ্ছামতো কাজ করার সুযোগ পাবেন তিনি। বিনিময়ে মালিককে প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট অংকের টাকা দিতে হবে।
এভাবে দুই বছর কাজ করার পর হঠাৎ সেই স্পন্সর মারা যান। তখন বিপদে পড়েন মঞ্জুর। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘এরপর আমি টাকার বিনিময়ে অন্য একজন স্পন্সরের কাছ থেকে ভিসা লাগাই। ২০১২ সালের পর বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর স্পন্সর পাওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। যে ভিসা বিনামূল্যে পাওয়ার কথা, সেই ভিসা পেতে লাখ লাখ টাকা খরচ করতে হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু পরিবারের জীবন-জীবিকার কথা ভেবে এবং অন্য কোনো উপায় না পেয়ে আমি সুযোগটা নেই। আবারও টাকা দিয়ে কোম্পানির ভিসা নিয়ে নিজের মতো কাজ করতে লাগলাম। এভাবে দু’বছর বেশ ভালোই কাটল। এরপর কিছুদিনের জন্য দেশে ছুটিতে আসি। পরে ফিরে গিয়ে আবারও দু’বছরের ভিসা নেই বাংলাদেশি প্রায় দুই লাখ টাকার বিনিময়ে, যা অন্যান্যবারের চেয়ে বেশি। অগ্রিম আরও দুই লাখ টাকা দিলাম পরবর্তী দু’বছরের ভিসা নবায়নের জন্য। কিন্তু পরবর্তী নবায়নের এক বছর চার মাস আগেই মালিক আমার নামে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন।’
মঞ্জুরের দাবি, আমি পালিয়ে গিয়ে অন্য কোথাও কাজ করছি। অথচ তার কোম্পানিতে কাজ করব না শর্তে তাকে (আগের কোম্পানির মালিক) টাকা দিয়েছি। যদিও তার অভিযোগ করার বিষয়টি আমার জানা ছিল না।
তিনি বলেন, প্রশাসনের কাছে মালিকের অভিযোগের বিষয়টি না জানায় ভিসা নবায়নের জন্য তাকে আরও দুই লাখ ২০ হাজার টাকা দেই। তিনিও আমাকে আশ্বস্ত করেন। অথচ ভিসা পাওয়ার যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেও কোনোভাবেই তার কাছ থেকে ভিসা পাচ্ছিলাম না। এদিকে আমার আগের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।
২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে কাজ থেকে ফেরার পথে মঞ্জুর পুলিশের হাতে আটক হন। সাধারণ নিয়মে নতুন ভিসা আবেদন দেখিয়ে কিছু জরিমানা দিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়ার কথা। কিন্তু পুলিশ ডাটা চেক করে জানায়, তার (মঞ্জুর) বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এক বছর চার মাস আগে। এ কারণে তাকে আর ছাড়া হয়নি। পরের দিন মঞ্জুরকে জেলে পাঠানো হয়।
মঞ্জুর জাগো নিউজকে বলেন, ‘জেলে পাঠানোর পর আমার মামা সেই মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভিসাটি সংগ্রহের চেষ্টা করেন। ভিসা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ওই মালিক আমার মামার কাছ থেকেও বাংলাদেশি ৬০ হাজার টাকা আদায় করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভিসা দেয়ার পরিবর্তে পালিয়ে যান।’
মঞ্জুরকে প্রথমে আবুধাবির নতুন জেলে কিছুদিন রাখা হয়। পরে তাকে অন্য জেলে সরিয়ে নেয়া হয়। এ সময় তিনি ফোন করার সুযোগ পেয়ে মামার কাছে জানতে পারেন, মালিক টাকা নিয়েও ভিসা না দিয়ে পালিয়ে গেছে।
পরবর্তীতে মঞ্জুরসহ আরও ৫৬ বাংলাদেশিকে শূন্য হাতে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। মঞ্জুর বলেন, জেলে থাকা অবস্থায় আমার মতো অনেক বাংলাদেশিকে খুঁজে পাই। যারা মোটা অংকের টাকা দিয়েও ভিসা নবায়ন করতে গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন।
মঞ্জুর আহম্মদের মতে, বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা বন্ধ থাকায় নতুন শ্রমিক দেশটিতে যেতে পারছে না। পুরাতন শ্রমিকরা পরিবার ও দেশের কথা ভেবে মালিককে টাকা দিয়ে এভাবে ভিসা নিয়ে থাকেন। অথচ আরব মালিকরা প্রতিনিয়ত বাংলাদেশিদের সঙ্গে প্রতারণা করে যাচ্ছেন। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।’
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) জাবেদ আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভিসা বিক্রির এ ঘটনা নতুন নয়। এ বিষয়ে আমরা আমাদের শ্রমিকদের প্রতিনিয়ত সতর্ক করছি।’