প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই অঞ্চলের জনগণের কল্যাণে দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ সম্পৃক্ততার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের জনগণের উন্নতি সহযোগিতার নানাক্ষেত্রে দেশগুলোর সফলভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার ওপর নির্ভর করছে।’
প্রধানমন্ত্রী শুক্রবার সন্ধ্যায় গণভবন থেকে দক্ষিণ এশীয় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ উপলক্ষ্যে আয়োজিত যৌথ ভিডিও কনফারেন্সের বক্তৃতায় এ কথা বলেন।
বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ও ভারতের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানেরা এই ভিডিও কনফারেন্সে সরাসরি যুক্ত ছিলেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অনুষ্ঠানে সূচনা ও সমাপনী বক্তৃতা প্রদান করেন।
আরো বক্তৃতা করেন আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আশরাফ গণি, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী থেসারিং তোবগে, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ ইয়ামিন আব্দুল গাইয়ুম, নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দাহাল এবং শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট মৈত্রীপালা শ্রীসেনা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা দক্ষিণ এশিয়ার সকল দেশের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে এই অঞ্চলকে একটি শান্তিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। যেখানে আমরা সুপ্রতিবেশীর মতই বসবাস করে আমাদের জনগণের জন্য গঠনমূলক নীতির বাস্তবায়ন করতে পারি, যে স্বপ্ন দেখেছিলেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ও ভারত যৌথভাবে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক সুদৃঢ়করণে অনেক সাফল্য অর্জন করেছে।
তিনি বলেন, আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত যে, এই উপগ্রহ উৎক্ষেপণ দক্ষিণ এশিয়ায় দেশগুলোর দৃশ্যপট বদলে দেবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দক্ষিণ এশীয় উপগ্রহ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশ এবং ভারত তাদের পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রকে স্থল, জল এবং আকাশপথ ছাড়িয়ে মহাশূন্য পর্যন্ত বিস্তৃত করলো।
তিনি বলেন, ‘আমি নিশ্চিত মহাশূন্যে এই সহযোগিতা আমাদের এই অঞ্চলের স্বার্থে আমাদেরকে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের উচ্চাকাক্সিক্ষ পথে নিয়ে যাবে।’
প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন দক্ষিণ এশীয় স্যাটেলাইট এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
জিস্যাট-৯ (জিএসএটি) বা দক্ষিণ এশীয় স্যাটেলাইটটি দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর জন্য উপহার হিসেবে ২৩৫ কোটি রুপি ব্যয়ে ভারত সরকার তৈরী করেছে।
জিএসএলভি-এফ০৯ শ্রেণীভুক্ত এই উপগ্রহটি ভারতীয় সময় বিকেল ৫টায় ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে ভারতের আইএসআরও’র (ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্স অর্গানাইজেশন) তত্ত্বাবধানে মহাশূন্যে উৎক্ষেপণ করা হয়।
অনুষ্ঠানে সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে উপগ্রহটির সফল মহাকাশ যাত্রার ভিডিও ক্লিপও প্রদর্শন করা হয়।
প্রায় ৩ বছর সময় নিয়ে আইএসআরও নির্মিত উপগ্রহটির নিক্ষেপণ যন্ত্রসহ এর ওজন ২ হাজার ২৩০ কেজি।
এই উপগ্রহের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার সংশ্লিষ্ট দেশগুলোÑ যোগাযোগ, দুর্যোগকালীন সহযোগিতা, দেশগুলোর প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ম্যাপিং, টেলি মেডিসিন, টেলি কমিউনিকেশ, টেলি এডুকেশন,তথ্য প্রযুক্তি সহ এক দেশের সঙ্গে অন্যদেশের জনগণের যোগাযোগ এবং দুর্যোগকালীন তথ্য সরবরাহে ব্যবহৃত হবে।
এই উপগ্রহটির মাধ্যমে ভারত তার প্রতিবেশী দেশগুলোর আরো কাছাকাছি অবস্থানে চলে আসবে বলেই আইএসআরও’র অভিমত।
এই উপগ্রহটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর দারিদ্র্য ও অশিক্ষা দূরীকরণসহ পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে এবং আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস দিয়ে সহযোগিতা করবে।
এজন্য উপগ্রহের সঙ্গে সংযুক্ত দেশগুলোর গ্রাউন্ড স্টেশন তৈরী করতে হবে, যার মাধ্যমে উপগ্রহটি থেকে ১২ কেইউ-ব্যান্ড ট্রান্সপন্ডারের মাধ্যমে সরবরাহকৃত ডাটা গৃহীত হবে।
এ সময় গণভবনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, ডাক ও টেলিয়োগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমসহ আমন্ত্রিত অতিথি এবং সরকারের পদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
শেখ হাসিনা তাঁর বক্তৃতার শুরুতেই সফল উপগ্রহ উৎক্ষেপণ এবং তাঁর সাম্প্রতিক ভারত সফরে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও আতিথেয়তা প্রদর্শনের জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, ভারত সরকার এবং সেদেশের জনগণকে ধন্যবাদ জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নরেন্দ্র মোদীজি আমি আপনার সঙ্গে আবারো কথা বলার সুযোগ পেয়ে আনন্দিত। একই সঙ্গে আজকে এই প্লাটফর্মটি আফগানিস্তান, ভুটান, মালদ্বীপ, নেপাল এবং শ্রীলংকার আমার অন্যান্য সন্মানিত সহকর্মীদের সঙ্গে ভাগ করতে পেরেও আনন্দিত।’
তিনি বলেন, এই সুযোগে গত এপ্রিল মাসের ৭ থেকে ১০ এপ্রিল ভারত সফরকালে আমাকে এবং আমার সফরসঙ্গীদের উষ্ণ আতিথেয়তা প্রদর্শনের জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং ভারত সরকারকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
শেখ হাসিনা বলেন, ভারত সফরকালে আমাদের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক আলোচনা, সম্পাদিত বিভিন্ন চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারক আমাদের সম্পর্কের গভীরতা এবং বহুমাত্রিকতার পরিচয় বহন করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকের এই মহতি অনুষ্ঠানে আমি আপনাকে ও ভারত সরকারকে দক্ষিণ এশীয় স্যাটেলাইট সফলভাবে উৎক্ষেপণের জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমি খুবই আনন্দিত যে, মাত্র ক’দিন আগেই আমরা দক্ষিণ এশীয় স্যাটেলাইটে সহযোগিতার বিষয়ে ‘অর্বিটাল ফ্রিকোয়েন্সী ’ চুক্তি স্বাক্ষর করেছি।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে এ অঞ্চলের জনগণের মধ্যে আগামীতে পারস্পরিক সহযোগিতা আরো উত্তোরত্তর বৃদ্ধির আশা প্রকাশ করে সকল দেশ ও জনগণের সুখ, সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন কামনা করেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, এই উপগ্রহ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সমঅনুভূতির বার্তাই প্রকাশিত হয়েছে।
তিনি বলেন, দক্ষিণ এশীয় স্যাটেলাইট এটা প্রমাণ করেছে যে, এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র আকাশ পর্যন্তই নয়, আরো বহুদূর বিস্তৃত।
মোদী হিন্দিতে বলেন, ‘সাবকা সাথ সাবকা ভিকাস’ (সকলের সঙ্গে সহযোগিতা এবং সকলের সঙ্গেই উন্নয়ন)। এটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার পথ নির্দেশক এবং ভারত একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বিকশিত হওয়ার জন্য সকলের সঙ্গে সহযোগিতার নীতিতেই বিশ্বাসী।
তিনি তাঁর ভিশনকে সফল করতে সার্বিক সহযোগিতা এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সকল সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত থাকার জন্য ধন্যবাদ জানান।
উল্লেখ্য, নেপালের কাঠমান্ডুতে ২০১৪ সালে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের সময়ই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য নিজস্ব উদ্যোগে উপগ্রহ উৎক্ষেপণের ঘোষণা দেন। পরবর্তীতে পাকিস্তান ভারতের স্যাটেলাইটে যুক্ত না হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ায় এর নাম পরিবর্তন করে সার্ক স্যাটেলাইটের পরিবর্তে সাউথ এশিয়া স্যাটেলাইট নামকরণ করা হয়। এ স্যাটেলাইট মিশনের মেয়াদ হচ্ছে ১২ বছর।