থেমে নেই জঙ্গি তৎপরতা। পলাতক জঙ্গিরাই সংগঠন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছে। তাদের মধ্যে কেউ জামিনে মুক্ত হয়ে আত্মগোপনে চলে গেছে, কেউ আবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। কেউ দলকে সংগঠিত করতে ভূমিকা রাখছে, কেউ হয়ে উঠছে আগের চেয়েও দুর্ধর্ষ। তাদের মধ্যে অনেকে আবার দেশের বাইরে গিয়ে সংগঠন পরিচালনা, অর্থায়নসহ নানা দিক থেকে ভূমিকা রাখছে।
দেশজুড়ে একের পর এক জঙ্গি আস্তানার সন্ধান লাভের বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে পুলিশ সদর দফতর। কারাগারে পাঠানো জঙ্গিদের জামিন এবং জামিনে থেকে আবারও জঙ্গিবাদে জড়ানোর বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হয়েছে সংশ্লিষ্টদের। তাই জঙ্গিদের চেয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এক ধাপ এগিয়ে রাখতে নেয়া হচ্ছে নতুন নতুন সিদ্ধান্ত, দেয়া হচ্ছে নির্দেশনা। এরই অংশ হিসেবে সারাদেশের পুলিশের মহানগর কমিশনার, ডিআইজিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জন্য নতুন নির্দেশনা জারি করা হয়েছে পুলিশ সদর দফতর থেকে।
নতুন এ নির্দেশনায় জামিনে থাকা জঙ্গি এবং জামিন নিয়ে পলাতক জঙ্গিদের তালিকা তৈরির কথা বলা হয়েছে। মঙ্গলবার পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক পর্যায়ের এক কর্মকর্তার স্বাক্ষরিত চিঠিতে জরুরি ভিত্তিতে জঙ্গিদের তথ্য হালনাগাদ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
হলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় হামলার দিন রাতে পুলিশ, র্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের অবস্থান।
চিঠিতে লেখা হয়েছে, ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত অর্থাৎ গত ১৫ মাসের জঙ্গিবাদ সংক্রান্ত দায়ের করা মামলায় যেসব আসামি জামিনে রয়েছেন এবং জামিনে থেকে পলাতক হয়েছেন তাদের হালনাগাদ তথ্য ই-মেইল ও ফ্যাক্সে পাঠাতে হবে। এছাড়া তথ্যগুলোর হার্ডকপি অ্যাডিশনাল ডিআইজি, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের ঠিকানায়ও পাঠাতে বলা হয়েছে।
পুলিশ সদর দফতর থেকে একযোগে চিঠিটি পাঠানো হয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার, রেলওয়ে পুলিশের প্রধান (অ্যাডিশনাল আইজিপি), কুমিল্লা, খুলনা, রাজশাহী, বগুড়া ও সিলেট মেট্রোপলিটনের পুলিশ কমিশনার এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহ রেঞ্জের ডিআইজি বরাবর।
তথ্য হালনাগাদের জন্য সংশ্লিষ্টদের আগামী ২ মে অর্থাৎ পরবর্তী সাতদিন সময় দেয়া হয়েছে।
নিজ নিজ রেঞ্জ ও জেলার জঙ্গিদের তথ্য দেয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট ছক তৈরি করে দেয়া হয়েছে। এতে জামিনপ্রাপ্ত ও পলাতকদের ক্রমিক নং, জেলা/ইউনিটের নাম, থানা/মামলা নম্বর/তারিখ/ধারা, জামিনপ্রাপ্ত আসামির নাম ও ঠিকানা, জামিনে পলাতক আসামিদের নাম, ঠিকানা এবং মন্তব্যের ঘর রয়েছে।
গুলশানে হামলার পর ইসলামিক স্টেট জঙ্গিগোষ্ঠী তাদের বার্তা সংস্থা ‘আমাক’ এ পাঁচ হামলাকারীর ছবিপ্রকাশ করে।
জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে দেশের দুই রেঞ্জের ডিআইজি এবং একজন মহানগর কমিশনার চিঠি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তারা জানান, ইতোমধ্যে তথ্য হালনাগাদের কাজ শুরু হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এ কাজ শেষ হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তারা।
ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার হিযবুত তাহরীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি), হরকাতুল জিহাদ (হুজি) ও জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) প্রায় হাজার খানেক সদস্যের জামিন হয়েছে। সংশ্লিষ্ট আদালতে পুলিশের পক্ষে সাক্ষী উপস্থিত করতে না পারায় তাদের অধিকাংশের জামিন হয়েছে বলে জানা গেছে।
আলোচিত জঙ্গিদের জামিন
২০১৪ সালে আইএস (ইসলামিক স্টেট) সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে আটক ব্রিটিশ নাগরিক সামিউন রহমানইবনে হামদান, সাবেক বিচারপতির ছেলে আসিফ আদনান ও সাবেক যুগ্ম সচিবের ছেলে ফজলে এলাহী হাই জামিন পান।
২০১৩ সালে ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীন হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেফতার সাদ আল নাহিন, কামাল হোসেন সরদার, কাওছার হোসেন ও কামাল উদ্দিন জামিন পান। নাহিনের জামিনদার ছিলেন তার চাচা শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক। এর দুদিন পর একই মামলার আসামি কাওছার, কামাল উদ্দিন ও কামাল হোসেন সরদারও জামিন পান।
গত বছরের আগস্টে খিলগাঁওয়ের পূর্ব গোড়ানে ব্লগার নীলাদ্রি চট্ট্যোপাধ্যায় নিলয় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকায় নাহিন, কাওসার ও কামাল হোসেন সরদারকে আবারও গ্রেফতার করে পুলিশ।
জঙ্গিবিরোধী অভিযানে অংশ নেয়া পুলিশের বিশেষ বাহিনী সোয়াট।
২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর গোপীবাগে কথিত পীর লুৎফর রহমানের বাসায় ঢুকে ছয়জনকে হত্যা মামলায় গ্রেফতার জেএমবি সদস্য মো. আজমীর ও গোলাম সারওয়ার ১৪ জুন হাইকোর্ট থেকে জামিন পান।
২০১৬ সালে গুলশানের হলি আর্টিসানের হত্যাযজ্ঞ এবং শোলাকিয়ার ঈদগাহ মাঠে হামলার পর জঙ্গিদের জামিনে বেরিয়ে যাওয়া এবং বিচার ঝুলে থাকা নিয়ে আলাদা একটি সেল গঠনের পরামর্শ দেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা (অ্যাটর্নি জেনারেল) মাহবুবে আলম।
অ্যাটর্নি জেনারেলের মতে, ‘চালাকি’ করে অনেক জঙ্গি বিভিন্ন মামলায় জামিন নিচ্ছে। সেল গঠন হলে তা বন্ধ হবে। উদাহরণ দিয়ে তিনি ওই সময় বলেন, ‘অনেক জঙ্গি নানা রকম চালাকির সুযোগ নিচ্ছে। তারা দরখাস্তে লিখছে ১৭ নম্বর কোর্টে মুভ (মামলা নিয়ে যাবে) করবে। কিন্তু মুভ করছে ১৩ নম্বর কোর্টে। ফলে ওই কোর্ট এটা জানতে পারছে না যে সে জঙ্গি কিনা। যদি সেল সবসময় ট্র্যাকিং করতে থাকে, কোন জঙ্গি কোন কোর্টে মামলা নিয়ে মুভ করল এবং ইমিডিয়েটলি যদি আমাকে জানানো হয়, তাহলে আমরা বা আমার সহকর্মীরা প্রবলভাবে বাধা দিতে পারি।’
সেল গঠনের বিষয়ে বুধবার অ্যাটর্নি জেনারেলকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। তবে এ ধরনের কোনো সেল এখনও গঠন হয়নি।