বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ড সভায় অনুমোদিত নতুন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে আগ্রহপত্র (এলওআই) বিতরণ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল সোমবার ৩০টি শর্তে আগ্রহপত্র চূড়ান্ত করা হয়। এসব শর্ত পূরণ করে আগামী ৬ মাসের মধ্যে ব্যাংকগুলোকে চূড়ান্ত লাইসেন্স নিতে হবে। আজ ও আগামীকাল বুধবারের মধ্যে ইস্যু করা আগ্রহপত্র ব্যাংকগুলো পেয়ে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এসকে সূর চৌধুরী মঙ্গলবার বাংলানিউজকে তার দপ্তরে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ‘সোমবার ৩০টি শর্ত চূড়ান্ত করে আগ্রহপত্র বিতরণ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। মঙ্গলবার থেকে তা বিতরণ শুরু হয়েছে। দুই দিনের মধ্যে তা ব্যাংকগুলোতে পৌঁছে যাবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আগামী ৬ মাসের মধ্যে এসব শর্ত পূরণ করে লাইসেন্স নিতে না পারলে সে আবেদন বাতিল হয়ে যাবে।’
এসকে সূর বলেন, ‘এলওআই ইস্যুর তারিখ থেকে ৬ মাসের মধ্যে ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ে কোনো ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করতে ব্যর্থ হলে, সময় বাড়ানোর জন্য পর্ষদের কাছে আবেদন করা যাবে। আর এ সময়ে ব্যাংকগুলো আবেদনের তথ্য, চেয়ারম্যানসহ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যসহে যে কোনো ধরনের পরিবর্তন আনতে পারবে।’
প্রসঙ্গত, গত ৮ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ড সভায় দেশীয় উদ্যোক্তাদের মালিকানায় ৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। এর আগে ৪ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের মালিকানায় তিনটি বাণিজ্যিক ব্যাংক (এনআরবি ব্যাংক) অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। অনুমোদন পাওয়া ব্যাংকের তালিকায় রয়েছে, সরকারি প্রতিষ্ঠান-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ‘ফার্মারস ব্যাংক’। তিনি ব্যাংকটির প্রস্তাবিত চেয়ারম্যান। আরও আছে সরকারদলীয় সাংসদ ও প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় ফজলে নূর তাপসের ‘মধুমতি ব্যাংক’। এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নাম আছে জনৈক হুমায়ুন কবীরের।
বিবেচিত নতুন ব্যাংকের তালিকায় আছে ইউনিয়ন ব্যাংক। জানা গেছে এর পেছনে রয়েছে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তবে এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নাম রয়েছে শহীদুল আলম নামের এক ব্যক্তির। সাংসদ এইচ এন আশিকুর রহমান ও নসরুল হামিদের প্রস্তাবিত ব্যাংক হচ্ছে ‘মেঘনা ব্যাংক’। চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন আশিকুর রহমান। প্রধানমন্ত্রীর আয়কর উপদেষ্টা এসএম মনিরুজ্জামানের ‘মিডল্যান্ড ব্যাংক’ এবং এম আমজাদ হোসেনের ‘সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংক লিমিটেড’।
গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন ব্যাংকের জন্য আগ্রহী উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে আবেদন চেয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এতে যথাযথ প্রক্রিয়া ও শর্ত সাপেক্ষে আবেদন আহ্বান করা হয়ে। এতে আগ্রহীদের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে অফেরতযোগ্য ১০ লাখ টাকার জামানতসহ আবেদন করতে বলা হয়।
এ নিয়ে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত প্রকাশ্যে সাংবাদিকদের জানান, নতুন ব্যাংক দেওয়া হবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। তিনি সংসদেও বিষয়টি তুলে ধরেন। পরে নমনীয় হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সর্বশেষ ১৬ সেপ্টেম্বর বোর্ড সভায় নতুন ব্যাংক দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়।
সূত্র জানায়, মোট ৩৭টি আবেদন জমা পড়ে নতুন ব্যাংকের জন্য। এর মধ্যে প্রাথমিক বাচাইয়ে ১৬টি আবেদন চূড়ান্ত করে কমিটি। তালিকা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে পাঠানো হয়। আর সরকার চূড়ান্ত করে একটি তালিকা পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংকে।
এদিকে আরোপিত শর্তগুলো ব্যাংক গাইডলাইন অনুযায়ী দেওয়া হয়েছে। শর্তের মধ্যে রয়েছে ব্যাংক ঢাকার বাইরে প্রধান কার্যালয় খুলবে নতুন শাখা, এক্সচেঞ্জ হাউস, তারল্য সহায়তাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এনআরবি ব্যাংকগুলোকে বৈদেশিক বাণিজ্যে অবদান, বিশেষ করে সভরেন বন্ড বিক্রির শর্ত দেওয়া হবে। এ ছাড়া এনআরবি ব্যাংকের আবেদন আহ্বানের সময় তাদের পরিশোধিত মূলধন ২০০ কোটি টাকা এবং মোট মূলধন ৪০০ কোটি টাকার কথা বলা হয়েছিল। তবে তা বাড়িয়ে ৪০০ কোটি ও ৮০০ কোটি টাকা করা হচ্ছে। পরিশোধিত মূলধনের পুরো অর্থই ডলারে পরিশোধ করতে হবে।
নতুন ব্যাংকের আবেদন আহ্বানের সময় ঋণ বা কর খেলাপির বিষয়ে যেসব শর্তের কথা বলা হয়েছিল, তা বহাল রাখা হচ্ছে। সে মোতাবেক কোনো ব্যক্তি অথবা তার পরিবারের সদস্য ঋণ বা কর খেলাপি হলে তিনি ব্যাংকের উদ্যোক্তা হতে পারবেন না। এমনকি কেউ গত ৫ বছরের মধ্যে ঋণ বা কর খেলাপি থাকলে এবং এ বিষয়ক মামলা অনিষ্পন্ন থাকলে তিনি নতুন ব্যাংকের উদ্যোক্তা হতে পারবেন না। তাইএসব ব্যাংকের কোনো উদ্যোক্তা খেলাপি হলে তাকে বাদ দিয়ে প্রয়োজনে নতুন উদ্যোক্তা নিতে বলা হবে। পরিশোধিত টাকা হতে হবে সাদা টাকা।
এসব ব্যাংক শহরে একটি শাখা খুললে গ্রামেও একটি শাখা খুলতে হবে। নতুন ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের কমপক্ষে ৫ শতাংশ কৃষি খাতে, আগের বছরের নিট আয়ের ১০ শতাংশ সিএসআর খাতে ব্যয় করতে হবে। পরিচালনা পর্ষদ সর্বাধিক ১৩ সদস্যের হতে পারবে। একজন উদ্যোক্তা সর্বনিম্ন ১ কোটি টাকার শেয়ার এবং সর্বোচ্চ মোট মূলধনের ১০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে পারবেন। কোনো ব্যক্তি, কোম্পানি বা কোনো পরিবারের সদস্যরা একক, যৌথ বা উভয়ভাবে ব্যাংকের মোট মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণ করতে পারবেন না। কোনো পরিবারের সদস্যরা সমষ্টিগতভাবে ৫ শতাংশের বেশি শেয়ারের অধিকারী হলে ওই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ২ জন পরিচালক হতে পারবেন। তবে শেয়ার ৫ শতাংশের কম থাকলে ১ জনের বেশি পরিচালক হওয়া যাবে না। উদ্যোক্তাদের তাদের আয়কর বিবরণীতে প্রদর্শিত নিট সম্পদ হতে ব্যাংকের মূলধন সরবরাহ করতে হবে। ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরুর তিন বছরের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্বানুমতি ছাড়া উদ্যোক্তা শেয়ার হস্তান্তর করা যাবে না।