ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তফসিলসহ নির্বাচনের সব কার্যক্রম তিন মাসের জন্য স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট।
একইসঙ্গে আদালত নির্বাচনের তিন মাস আগে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার নির্দেশও দেওয়া হয়।
এই দুটি আদেশ ছাড়াও আইনের যথাযথ বিধান অনুসরণ না করে নির্বাচন অনুষ্ঠান করাকে কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত।
ঢাকা সিটি করপোরেশন উত্তর ও দক্ষিণের নির্বাচন স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে দাখিল করা রিটের শুনানি শেষে সোমবার দুপুর পৌনে দুইটায় বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতের আদেশে বলা হয়েছে, ‘ইসিকে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯ অনুসরণ করতে হবে। নতুন কতটি কাউন্সিলর পদ থাকেব তাও ঘোষণা করতে হবে।’
দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার, স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব, নির্বাচন কমিশন সচিব, ঢাকা জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, দুই রিটার্নিং কর্মকর্তা, দুই কর্পোরেশনের প্রশাসককে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে ড. শাহদীন মালিক শুনানি করেন।
মনজিল মোরসেদ আদালতে বলেন, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সম্পূর্ণ নতুন সিটি করপোরেশন। ঢাকা সিটি করপোরেশন এখন ইতিহাস। নতুন সিটি করপোরেশন হলে তার জন্য যে আইন রয়েছে তা অনুসরণ করতে হবে। সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। কাউন্সিলর সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে। কিন্তু এখানে সিডিউলে কিছুই করা হয়নি। গুলিস্তান থেকে রামপুরা পর্যন্ত একটা লোক হেঁটে গেল আর বললো এ পাশে উত্তর ওই পাশে দক্ষিণ, এভাবে করলে তো আর হবে না। অথবা এটা ছেলের হাতের মোয়া নয়, যে এক ছেলের কাছ থেকে নিয়ে আরেক ছেলেকে দিয়ে দেবে।’
দৈনিক ইত্তেফাকের একটি সংবাদ আদালতে উপস্থাপন করে মনজিল বলেন, নতুন পাঁচ লাখ ভোটার হওয়ার যোগ্য লোক ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি। ভোটার তালিকা হালনাগাদ না করার কারণে তারা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘ঢাকা উত্তর এবং দক্ষিণ নতুন কোনো সিটি করপোরশেন নয়। এটি আইন দ্বারা বিভক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট দুটি সিটি করপোরেশন। আইনেই সরকারকে বিভক্তকরণের ক্ষমতা দিয়েছে। এ কাজ ইসির নয়। এ দায়িত্ব সরকারের। রিট আবেদনকারী যে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন তা নতুন সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। নতুন সিটি করপোরেশন ঘোষিত হলে কীভাবে সীমানা নির্ধারণ করতে হয় সেটা আইনে বলা আছে।’
এ পর্যায়ে আদালত বলেন, ‘উত্তর এবং দক্ষিণের মাধ্যমে দুটি করপোরেশন নির্ধারণ করা হয়েছে। সেটা কী নতুন নয়?’
জবাবে মাহবুবে আলম বলেন, এ রিটে স্থানীয় সরকার বিভাগকে বিবাদী করা হয়নি। রিটের বিষয়গুলোর জন্য ইসি দায়ী নয়। রিটের বিষয়গুলো দেখবে স্থানীয় সরকার। উত্তর এবং দক্ষিণ নতুন হলেও এটি বিদ্যমান সিটি করপোরেশনের একটি অংশ। বিষয়টিকে সেভাবে বিবেচনা করতে হবে।’
শাহদীন মালিক বলেন, সংশোধিত আইনের মাধ্যমে সিটি করপোরেশনকে বিভক্তিকরণ করা হয়েছে। এসময় আদালত বলেন, সংশোধিত আইনে আগের আইনকে বাতিল করা হবে এ কথা বলা হয়নি।
আদালত আরও বলেন, ‘নতুন প্রজন্মের পাঁচ লাখ ভোটার হয়নি। আপনারা কেন ভোটার তালিকা হালনাগাদ করেননি।’
জবাবে শাহদীন মালিক বলেন, ‘এটা সংবাদপত্রের প্রতিবেদন। রিটের বিষয়বস্তু নয়।’
আদালত বলেন, ‘এটি বাংলাদেশের বিশ্বস্ত দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিবেদন। এ প্রতিবেদনটি যিনি রচনা করেছেন তাকে এ আদালত ভালো করে চেনেন। তিনি কোনো ভুল প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারেন না। আপনি মোবাইল ফোনে ইসির কাছ থেকে জানুন। সর্বশেষ কবে হালনাগাদ করা হয়েছে।’
এসময় আদালত কক্ষের বাইরে গিয়ে ইসির সঙ্গে কথা বলে এসে শাহদীন মালিক জানান, ‘ইত্তেফাকের প্রতিবেদনটি সঠিক। যিনি প্রতিবেদনটি লিখেছেন তিনিও এ আদালতে উপস্থিত আছেন।’
এ পর্যায়ে আদালত ইত্তেফাকের আইন, সংবিধান ও নির্বাচন কমিশন বিষয়ক সম্পাদক সালেহ উদ্দিনের কাছে তার প্রতিবেদন সম্পর্কে বক্তব্য শুনতে চান।
এ সময় সালেহ উদ্দিন বলেন, ‘এ রিট আবেদনের আগেই প্রতিবেদনটি লেখা হয়েছে। আইনে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, প্রতিবছর ৩ থেকে ৩১ জানুয়ারির মধ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে হবে। কিন্তু গত তিন বছর ধরে তা করা হচ্ছে না। পাঁচ লাখ নতুন প্রজন্ম ভোটার হতে পারেননি সেটা ইসির হিসেব থেকে নেওয়া।’
এরপর আদালত বলেন, ‘তফসিল ঘোষণার পরে আদালত নির্বাচনের কার্যক্রমের ওপর হস্তক্ষেপ করে না। কিন্তু এখানে অনেকগুলো প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। কাউন্সিলরের সংখ্যা নির্ধারণের জন্য কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হয়নি।’
এসময় আদালত অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি কী বলবেন না এটা নতুন সিটি করপোরশন?’
জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘দুটি করায় এটিকে নতুন বলে ধরে নেওয়া যায়।‘
তখন আদালত বলেন, ‘যদি তাই হয় তাহলে আদালত আইনের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে হালকাভাবে দেখতে পারে না। এরপর আদালত আদেশ দেন।’
প্রসঙ্গত, রোববার বেলা ১২টায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ এ রিট দায়ের করেন। পরে রোববার আংশিক শুনানি হয়।
এর আগে বৃহস্পতিবার ডিসিসি নির্বাচন বন্ধ রাখতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ তিনজনের প্রতি হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান সিদ্দিকীর পক্ষে উকিল নোটিস পাঠান অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ।
বেঁধে দেওয়া ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জবাব না দেওয়ায় পরবর্তীতে এ রিট দায়ের করা হয়।
উকিল নোটিস পাওয়াদের মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদ ছাড়া অপর দুই জন হলেন, নির্বাচন কমিশন সচিব ড. মোহাম্মদ সাদিক ও ঢাকা জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা শাহ আলম।
ওইদিন মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন-২০০৯ এর ২৭, ২৮ ও ২৯ ধারা অনুযায়ী নতুন সিটি করপোরেশনের কয়টি ওয়ার্ড তা নির্ধারণ করতে হবে এবং এসব ওয়ার্ডের সীমানাও নির্ধারণ করতে হবে। এ সীমানা নির্ধারণের জন্য কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে গেজেট প্রকাশ করতে হবে। আইনের এসব ধারা কার্যকর না করে নির্বাচন করা যাবে না। আর আইনের এ ধারাগুলো সিটি করপোরেশন পালন করেনি। তাই আইন অনুযায়ী নির্বাচন করার সুযোগ নেই।’