‘১৩’ কি অপয়া? সংস্কারবাদীদের চোখে সংখ্যা ‘১৩’ অপয়াই। অনেকেই ১৩ তারিখে কোন শুভ কাজ করতে চান না। পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করেন। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি-বাস্কেটবল আর রাগবির জার্সিতে সহজে কেউ ১৩ নম্বর নিতে চান না। ক্রিকেটে কোন ব্যাটসম্যান ১৩`তে পা রাখলেই ভক্ত-সমর্থকরা উসখুস করেন, প্রিয় ব্যাটসম্যানটা এই বুঝি আউট হয়ে গেল। সংখ্যাতত্ত্বে যতই অপয়া ভাবা হোক না কেন, বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাস লিখতে গেলে অতিবড় ইতিহাসবিদও কিন্তু সেই ‘১৩’ কে অপয়া লেখতে পারবেন না। অপয়া লেখা বহুদূরে, ১৩ সংখ্যাকে পাশ কাটিয়ে যাবারও কোন সুযোগ-অবকাশ নেই।
বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাস পর্যালোচনায় বেড়িয়ে আসবে সংখ্যা ‘১৩`র অন্যরকম রূপ। যা মোটেই অপয়া নয়। বরং সবচেয়ে পয়োমন্তঃ। শুভ। এদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসের সবচেয়ে স্মরণীয় দিনটিই ছিল ১৩। আজ তো ১৩ এপ্রিল। ঠিক ধরেছেন, আজকের দিনটিই বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের হীরকখচিত একদিন।
ইতিহাস জানাচ্ছে, আজকের দিনেই বাংলাদেশের ক্রিকেট আকাশে উঠেছিল এক নতুন সূর্য। সে সূর্য সাফল্যের সিঁড়ি বেঁয়ে উপরে ওঠার প্রতীক। নতুন পথে যাত্রার শুভ দিন হয়েই আছে। এখন যে দেশ বিশ্ব ক্রিকেটের প্রতিষ্ঠিত শক্তির তকমা লাগানোর অপেক্ষায়, সেই বাংলাদেশ ২০ বছর আগে আজকের দিনে জায়গা করে নিয়েছিল ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
আজ কেনিয়া, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, আফগানিস্তান আর নেদারল্যান্ডস যে জায়গায় দাঁড়িয়ে, তখনকার বাংলাদেশও ঠিক ঐ কাতারেই ছিল। ১৯৯৭ সালে ঠিক আজকের দিনে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের কিলাত ক্লাব মাঠে মরিস ওদুম্বে, স্টিভ টিকোলো, টনি সুজি আর কেনেডি ওটিয়ানোর কেনিয়াকে হারিয়ে ঠিক সেখান থেকে এক ধাপ উঁচুতে জায়গা করে নিয়েছিলেন আকরাম খান, মিনহাজুল আবেদিন, আমিনুল ইসলাম, খালেদ মাহমুদ, খালেদ মাসুদ, মোহাম্মদ রফিক, সাইফুল ইসলাম আর হাসিবুল হোসেন শান্তরা। কেনিয়াকে রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ে ২ উইকেটে হারানোর মধ্য দিয়ে আইসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। লাল সবুজ পতাকা উড়েছিল পত পত করে।
বিশ্ব দেখেছিল, জেনেছিল ক্রিকেটের নতুন শক্তি বাংলাদেশের অভুদ্যয়। মনে হয় যেন এই সেদিন। কিন্তু দেখতে দেখতে কেটে গেছে ২০ বছর। আজ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার মত দলের ভীত কাপিয়ে দেয় টাইগাররা। বাঘের গর্জনে তটস্ত ক্রিকেট বিশ্ব। ২০ বছর আগে কুয়ালালামপুরের কিলাত ক্লাব মাঠে যে বাঘের জন্ম, তা আজ ২০ বছরের যুবা। বাঙালির প্রাণের উৎসব, চেতনা ও ঐতিহ্যর প্রতীক বাংলা নববর্ষ দরোজায় কড়া নাড়ছে।
রাত শেষে পূব আকাশ লাল করে উঠবে সূর্য। সূচিত হবে বাংলা নববর্ষ। এ বর্ষবরণের সম্ভাব্য সব রকম প্রস্তুতি চলছে। ঘরে-বাইরে, অফিসে-আদালতে ও রেস্তেরায়। কি দারুণ প্রাণ চাঞ্চল্য। সর্বত্র একটা উৎসব উৎসব আমেজ। এ উৎসব আনন্দে নতুন মাত্রার সংযোজন ঘটেছে এবার। তার ঠিক আগের দিনটিই আইসিসি ট্রফি বিজয়ের ২০ বছর পূর্তির দিন।
এখনো চোখের সামনে সে সুখ স্মৃতি জল জল করে জ্বলছে। মনের আয়নায় সে স্মৃতি এতটাই জাগ্রত যে, মনেই হয় না কুড়ি বছর কেটে গেছে। মনে হয় যেন এই সেদিন। এক বলে ১ রান চাই, ঠিক এমন সমীকরণ সামনে। কিলাত ক্লাব মাঠে সে কি উত্তেজনা! বেতারে ধারা বিবরণী শুনে থর থর করে কাপছে গোটা দেশ। শেষ বলে একটি মাত্র রান চাই। তাহলেই আইসিসির সহযোগী সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সেরা দলের স্বীকৃতি মিলবে। বাংলাদেশ হবে আইসিসি ট্রফি বিজয়ী।
স্নায়ুক্ষয়ী সে মুহূর্তে বোলার ছিলেন কেনিয়ান পেসার টনি সুজি। স্ট্রাইকে হাসিবুল হোসেন শান্ত। অপর প্রান্তে খালেদ মাসুদ পাইলট। শেষ বলটি ছোড়ার আগে উইকেটের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুই ব্যাটসম্যান শলা পরামর্শ করে নিলেন। বোঝাই গেল, হাসিবুল হোসেন শান্ত ও খালেদ মাসুদ পাইলটের মধ্যে একটি কথাই হয়েছিল, বল ব্যাটে লাগুক আর নাই লাগুক আমরা দৌড়ে প্রান্ত বদল করে নিব।
অন্যদিকে কেনিয়ানরা এক বড় ভুল করে ফেললো। আজকাল ডাকওয়ার্থ লুইস ম্যাথড বা ডিএল ম্যাথডে অনেক ম্যাচের ভাগ্যই নির্ধারিত হয়। বৃষ্টি হওয়া মাত্র সবাই ডিএল ম্যাথড নিয়ে বসে যান। কিন্তু তখন এই ম্যাথড তেমন বিস্তৃত হয়নি। তাই হয়তো কেনিয়ানরা বুঝে উঠতে পারেনি। তাদের ধারণা ছিল শেষ বলে দুই রান লাগবে। কিন্তু ডিএল ম্যাথড হচ্ছে যেটা টার্গেট, সেটাই ছুতে হবে। বাংলাদেশের টার্গেট ছিল ১৬৬। আর কেনিয়ানরা ভেবেছিল বৃষ্টিতে তাদের স্কোর ছোট হয়ে ১৬৬`তে আকার নিয়েছে। বাংলাদেশের ১৬৭ করতে হবে। তা ভেবেই কেনিয়ানরা শেষ বলে ব্যাটসম্যানকে ছাতার মত ঘিরে না ধরে মাঠের আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফিল্ডার রাখলো। এখন কোন ম্যাচের শেষ বলে প্রতিপক্ষের এক রান দরকার পড়লে ফিল্ডিংয়ে থাকা অধিনায়ক নিশ্চিতভাবেই সব ফিল্ডারকে ৩০ গজের ভিতরে নিয়ে আসেন।
কিন্তু ১৯৯৭ সালে ১৩ এপ্রিল আইসিসি ট্রফির ভাগ্য নির্ধারণী ডেলিভারিতে আর তা হয়নি। অন্য আট দশটা ডেলিভারির মত সীমানার কাছাকাছি বেশি ফিল্ডার নিয়েই বল করলেন কেনিয়ান পেসার টনি সুজি। মিডল ও লেগ স্টাস্পের আশপাশে পড়ে লেগের দিকে আসা সে ডেলিভারি ব্যাটে আনতে পারলেন না হাসিবুল হোসেন শান্ত। তার প্যাডে লেগে বল চলে গেল শর্ট ফাইন লেগে। কিন্তু তাতে কি? সেখানে তেমন কোন ফিল্ডার ছিল না। কিপার কেনেডি ওটিয়ানো বাঁ দিকে ৪/৫ পা দৌড়ে তা ধরে গ্লাভসে নিতে নিতেই হাসিবুল দৌড়ে অন্য প্রান্তে পৌঁছে গেলেন। নন স্ট্রাইকার খালেদ মাসুদও ব্যাটিং প্রান্তে। উইকেটের ১২/১৪ গজ পেছনে থাকা কীপার ওটিয়ানো বল কুড়িয়ে উইকেটে ছোড়ার আগেই প্রান্ত বদল। সিঙ্গেলস পূর্ণ হবার সঙ্গে সঙ্গে হাসিবুল ছুটলেন মাঠের পাশে তাবু খাটানো অস্থায়ী ড্রেসিং রুমে।
তখনকার বিসিবি প্রধান আজকের আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সাবের হোসেন চৌধুরীসহ সে সময়ের বোর্ড কর্তাদের সবাই সবুজ লাল টি-শার্ট পড়ে আনন্দের অতিশয্যে দৌড়ে চলে আসলেন মাঠের ভিতরে। কিলাত ক্লাব হয়ে গেল বাঙালির ক্রিকেট উৎসব আনন্দে মেতে ওঠার কেন্দ্রস্থল। ‘বাংলাদেশ-বাংলাদেশ’ ধ্বনিতে তখন কিলাত ক্লাব মাঠ ও তার আশপাশের আকাশ বাতাস কেপে কেপে উঠলো। সে কি আনন্দ! মুখের হাসি, মনে সৃষ্টি সুখের উল্লাস আর চোখে আনন্দের অশ্র ক্রিকেটার, কোচ, ম্যানেজার, বোর্ড কর্মকর্তা, ঢাকা থেকে যাওয়া বিভিন্ন ক্লাব কর্মকর্তা, সাংবাদিক আর প্রবাসী বাঙালি, সবাই এক হয়ে ভাগ করে নিলেন ঐ বিজয় আনন্দ।
দেশে তখন রাজ্য জয়ের আনন্দ। সৃষ্টি কর্তার কি অপরূপ মহিমা! যে ১৩ কে অপয়া ভেবে নানা তির্যক ও নেতিবাচক কথা-বার্তা বলা হয়। সংখ্যাতত্ত্বে যে ১৩ অশুভ এমন ধারণা প্রবাহমান, সেই ১৩ এপ্রিল হয়ে থাকলো বাঙালির ক্রিকেট উৎসবে মেতে ওঠার দিন। ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় মঞ্চে ওঠার দিন।
শুনে অবাক হবেন, তা কিন্তু হবার কথা ছিল না। ফাইনালের দিন নির্ধারিত ছিল ১২ এপ্রিল। আগেই বলা ছিল, যেহেতু এটা আইসিসি ট্রফি ফাইনাল, তাই প্রাকৃতিক কারণে আজ খেলা শেষ না হলে পরদিন মানে রিজার্ভ ডে`তে খেলা গড়াবে। বৃষ্টি না আসলে হয়ত ঐ ১২ এপ্রিলই হয়ে থাকতো বাঙালির ক্রিকেট বিজয় উৎসবের দিন। কিন্তু বৃষ্টির কারণে একদিনের ম্যাচ দু`দিনে নিষ্পত্তি হওয়ায় ১২ এপ্রিলের পরদিন মানে ১৩ এপ্রিল খেলা গড়ালো।
১২ এপ্রিল প্রথম ব্যাট করে কেনিয়া তুলে ফেললো ২৪১ রানের লড়িয়ে পুঁজি। পরবর্তীতে যিনি বাংলাদেশের ঘরের ক্রিকেটের নিয়মিত মুখ হয়ে পড়েছিলেন, সেই কেনিয়ান সুপার স্টার স্টিভ টিকোলো একাই করলেন ১৪৭ (১৫২ বলে)। কেনিয়ান ইনিংস শেষ হতেই শুরু হলো বৃষ্টি। ১২ এপিল আর খেলাই হল না। যেহেতু রিজার্ভ ডে ছিল, তাই পরদিন মানে ১৩ এপ্রিল খেলা গড়ালো। সেদিনও কিন্তু সকাল সকাল খেলা শুরু হয়নি। খেলা যদিও সিনথেটিক টার্ফে ( সবুজ রঙ্গের রাবারের তৈরি এক রকম কৃত্রিম টার্ফ) হয়েছিল। তাই বৃষ্টিতে পিচের কোন ক্ষতি হয়নি।
কিন্তু আউটফিল্ড ভিজে একাকার। সেই মাঠ তৈরি করতে করতে লেগে গেল আধাবেলা। মালয়েশিয়ান সময় দুপুরে খেলা শুরু হলো। সময় কমে যাওয়ায় খেলার স্বাভাবিক দৈর্ঘ্যও হলো ছোট। ৫০ ওভারে ২৪২ রানের বদলে ডিএল ম্যাথডে বাংলাদেশের টার্গেট দাঁড়ালো ২৫ ওভারে ১৬৬।
কেউ সেঞ্চুরি করা দুরের কথা, পঞ্চাশেও পা রাখতে পারেননি। অমন কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অনিশ্চিত যাত্রা। প্রথম বলে ০ রানেই ভাঙলো উদ্বোধনী জুটি। কেনিয়ান পেসার টনি সুজির করা ইনিংসের প্রথম বলেই আউট নাইমুর রহমান। তারপর মোহাম্মদ রফিক (১৫ বলে ২৬), মিনহাজুল আবেদিন নান্নু (৩৩ বলে ২৬), আমিনুল ইসলাম বুলবুল (৩৭ বলে ৩৭), আকরাম খান (২৭ বলে ২২) , সাইফুল (১৩ বলে ১৪), খালেদ মাহমুদ সুজন (৫ বলে ৫) আর খালেদ মাসুদ পাইলট (৭ বলে ১৩) ও হাসিবুল হোসেন (৫ বলে ৪) করে সময়ের দাবি মেটালেন। এর মধ্যে খালেদ মাসুদ পাইলট শেষ দিকে জোড়া ছক্কা হাকিয়ে হিসেব সহজ করে দিলেন। পেসার সাইফুল লন টেনিসের ফোরহ্যান্ডের মত ডিপ মিড উইকেটে ওপর দিয়ে ছক্কা হাকিয়ে ওভার পিছু লক্ষমাত্রা কমিয়ে দিলেন। আর নয় নম্বরে নামা খালেদ মাহমুদ সুজন উইকেটে গিয়ে বাউন্ডারি হাকিয়ে বল ও রানের ব্যবধান কমালেন আরও।
মোদ্দা কথা, সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে সবার চেষ্টায় ওপরে ওঠার এক অনুপম দৃষ্টান্ত। সেই হাসিবুল, খালেদ মাসুদ, রফিক, খালেদ মাহমুদ, সাইফুল, মিনহাজুল, আমিনুল ও আকরাম, নাইমুর,ও এনামুল ও আতহারদের চেষ্টায় আইসিসি সহায়ক শক্তি থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্ব ক্রিকেটে প্রায় প্রতিষ্ঠিত শক্তি। আর তাদের পেছনে জালাল আহমেদ চৌধুরী, ওসমান খান ও গাজী আশরাফ হোসেন লিপুর প্রাণপণ চেষ্টা।
তৎকালিন বোর্ড প্রধান সাবের হোসেন চৌধুরী, দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল, প্রয়াত মাহমুদুল হক মানুসহ বোর্ড ও ঢাকার ক্লাব ক্রিকেট সংগঠক সবাই এক হাট্রা ছিলেন। যে যার অবস্থানে থেকে চেষ্টা করেছেন। সবার একটাই সংকল্প ছিল, আগের পাঁচবার পারিনি। যে করেই হোক এবার সাফল্যের বন্দরে পৌঁছাতেই হবে। সে সংকল্পের পরিসমাপ্তি ঘটলো ১৯৯৭ সালের ১৩ এপ্রিল।