প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার বলেছেন, ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারকগুলোর মধ্যে গোপনীয় কিছু নেই, সবকিছুই খোলামেলা এবং পরিষ্কার।
তিনি বলেন, আমি যতক্ষণ ক্ষমতায় রয়েছি ততক্ষণ মনে রাখবেন আমি নিজের স্বার্থে রাজনীতি করি না, দেশ ও জণগণের স্বার্থেই আমার রাজনীতি এবং দেশের মর্যাদাটাই আমার কাছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলেন, ‘আমার দ্বারা দেশের স্বার্থবিরোধী কোন কিছুই কখনো হবে না।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বিকেলে গণভবনে তাঁর সাম্প্রতিক ভারত সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে একথা বলেন।
অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী,পানি সম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমসহ মন্ত্রী পরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, সংসদ সদসবৃন্দ, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সম্পাদকবৃন্দ এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমের সিনিয়র সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় চুক্তির বিরোধিতাকারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘যারা সন্দেহ করছেন তারা নানা কথা বলছেন, যারা বলছেন তারা বলবেনই আমি জানি। এদের চরিত্র আমার জানা আছে। কিন্তু এতটুকু মনে রাখবেন, যেখানে আমি আছি সেখানে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কোন কিছু হবে না।’ এটা মনে রাখবেন। আমার দেশ স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। কিন্তু সমঝোতা প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে অবশ্যই হতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ডিফেন্স চুক্তির ব্যাপারে আমি এটুকু বলবো, যে বিষয়গুলো এসেছে তারমধ্যে একটা হচ্ছে কাঠামোগত সহযোগিতা, সেখানে দুই দেশের সেনাসদস্যদের প্রশিক্ষণ এবং আলোচনা সভা, এটি বর্তমানেও চলমান রয়েছে। তাদের সেখানে স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি সংবলিত অনুষ্ঠান উদযাপন করা, দুই দেশের সেনা সদস্যদের শিক্ষা সফর, সামরিক প্রশিক্ষক ও পর্যবেক্ষক বিনিময়, সামরিক সরঞ্জামাদির বিষয়ে পারষ্পরিক সহযোগিতা, শান্তিরক্ষা বিষয়ক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও অভিযান পরিচালনা, দুর্যোগ ও ত্রাণ বিষয়ক প্রশিক্ষণ, চিকিৎসা সহযোগিতা, দুই দেশের জাহাজ ও উড়োজাহাজের সফর বিনিময়, সমুদ্রে যৌথ টহল অনুশীলন ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়েই আমাদের আলোচনা।
এসয় তিনি ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ’ এবং ‘বিপসট’ যেখানে বিদেশী সৈনিকরাও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে তা তাঁর সরকারই করেছে এবং মিলিটারি একাডেমীসহ ডিফেন্সের যা কিছু উন্নতি তা আওয়ামী লীগ সরকারই করেছে বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা (পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক সরকারগুলো) তাদের (সশস্ত্রবাহিনী) ঘাড়ে পাড়া দিয়ে তাদের অস্ত্র ব্যবহার করে, তাদের রক্তে কেবল ক্ষমতাটাই দখল করেছে, কিন্তু আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর কোন উন্নতি করেনি। কিন্তু আওয়ামী লীগ যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে- তাই আমাদের হাতেই সশস্ত্রবাহিনীর উন্নয়ন সাধিত হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ভারত সফরে আপনারা দেখেছেন ১১টি চুক্তি এবং ২৪টি এমওইউ সই হয়েছে। এখানে আমাদের লুকা ছাপার কিছু নেই। অবশ্যই এই চুক্তির বিস্তারিত আপনারা জানতে পারেবেন। তিনি বলেন, আমি মনে করি ২১ বছর পর সরকারে এসে দেশ সেবার যে সুযোগটা পেয়েছি। অন্তত এটুক বলবো এখন পৃথিবীর যেখানেই যাই বাংলাদেশকে আমরা একটি মর্যাদার আসনে দেখতে পাই। এটা আমরা করতে পেরেছি। কারণ আমরাতো মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। আমাদের মনমানসিকতাটা আলাদা।
তিনি বলেন, মাঝখানে যারা ক্ষমতায় এসেছেন তারা একটু ভিন্ন ছিলেন। কাজেই তারাতো ঐ পরাজিত শক্তিকে নিয়েই দেশ চালাতে চেয়েছেন। বাংলাদেশের মর্যাদার দিকে তারা তাকাননি। আর আমাদের লক্ষ্য ছিল, মর্যাদা সব সময় ধরে রাখার দিকে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখানে একটি বিষয় হচ্ছে যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে পররাষ্ট্রনীতি নিয়েছিলেন- ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সাথেই বৈরিতা নয়।’ যে নির্দেশনা তিনি দিয়েছেন তা আমি অক্ষরে অক্ষরে পালনের চেষ্টা করছি। আর এজন্যই সকলের সঙ্গেই একটা সুসম্পর্ক আমরা তৈরি করতে সমর্থ হয়েছি। কোন দেশের সঙ্গে তাদের (ভারতের) সাধারণ সমস্যা থাকতে পারে। তবে, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে সকলের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলবে। উদ্দেশ্য একটাই বাংলাদেশের মানুষের দ্রুত জীবন মান উন্নত করা। বাংলাদেশকে দারিদ্র্যমুক্ত হিসেবে গড়ে তোলা এবং চাইলে যে এই ভারসাম্য রক্ষা করা যায়, এটা নিশ্চয়ই এতদিনে সকলেই উপলদ্ধি করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিয়ত যদি ভাল থাকে তো সবকিছুই ভাল মত করা যায়। আমাদের এখান থেকে প্রায় দুই আড়াইশ’ ব্যবসায়ী ভারত সফরে গিয়েছেন এবং আমি বলবো সেখানে সবাই নিজের নিজের মত পার্টনার খুঁজে পেয়েছেন। ব্যবসায়ীরা নিজেরাও ১২টি সমঝোতা স্বারক করেছেন এবং যৌখভাবে বা ভারতীয় বিনিয়োগ এখানে ব্যাপকভাবে এসেছে এবং আরো ব্যাপকভাবে বিনিয়োগে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ আর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে ভারতীয়রা গণ্য করে না উল্লেখ করে অপর এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশের মর্যাদা এক্ষেত্রে অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি বলেন, ‘পাক-ভারত যুদ্ধ, আর সেই যুদ্ধের মাধ্যমে যে বাংলাদেশের জন্ম তা নয়। বরং বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। সেখানে মিত্রবাহিনী হিসেবে ভারত আমাদেরকে সহযোগিতা করেছে। এটাই বাস্তব সত্য এবং ভারতীয়রাও এটাই সেভাবেই মেনে নেয়।’
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ জাতির পিতার নেতৃত্বে প্রথম শুরু হয় এবং তিনিই ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাবার এবং স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এই মুক্তিযুদ্ধতো আমাদের প্রায় ২৪ বছর ধরেই চলছিল। কিন্তু ডিসেম্বর মাস ১৯৭১ সালে ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধটা বাঁধে। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতা আমরা পেয়েছি এবং ভারতীয় সৈনিকরা আমাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তাঁরা জীবন দিয়েছে।
সরকার প্রধান বলেন, আমরা এবার দিল্লীর যেই জেনারেল ম্যানেকশ’ সেন্টারে ভারতীয় সেনাদের সম্মাননা জানিয়েছি, সেই ম্যানেক শ’ আমাদের মিত্রবাহিনীর প্রধান ছিলেন। আমরা ধানমন্ডীর ১৮ নম্বর রোডের বাসায় তখন বন্দি থাকলেও পাকিস্তানী হানানদার বাহিনীর কাছে তাঁর সেই বিখ্যাত আহবান আমরা শুনেছি- ‘হাতিয়ার ডাল দো।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা যাদের সহায়তায় স্বাধীনতা পেয়েছি তাদেও সম্মান দেখানো জাতি হিসেবে আমি মনে করি বাংলাদেশকে অনেক উচ্চ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সহযোগিতা করেছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তাদের সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা জীবন দিয়েছেন। আর সেখানে তাদের সঙ্গে একটা সমঝোতা স্মারক করতে এত প্রশ্ন কেন আসে। এটাই আমার প্রশ্ন। আমরা বন্ধুকে চিনি না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যাদের সাথে যুদ্ধ করলাম। যারা আমাদের বিরোধিতা করলো। তাদের সঙ্গে কোন চুক্তি করতে আমাদের বাঁধে না। তখন প্রশ্ন ওঠে না। যারা টক শো করছেন, আলোচনা করছেন, সমালোচনা করছেন, প্রেস কনফারেন্স করে নানা কথা বলে দিচ্ছেন তাদের কাছে বরং আমি এই শ্রশ্নটা করতে চাই। সেই প্রশ্নের উত্তর তাদের জাতির কাছে দিতে হবে। এটা হলো বাস্তবতা।
শেখ হাসিনা বলেন, যা হোক আমি এটুকই বলতে চাই বাংলাদেশের সার্বিক স্বার্থ বজায় রেখেই আমরা যা করি সেটা করবো। আর এখানে আমরা কোন দেশ থেকে কি করবো না করবো তার কোন বাইন্ডিং নাই। এটাও সম্পূর্ণ আমাদের নিজেদের ইচ্ছা।
এ সময় ভারত থেকে নেয়া বিভিন্ন ঋণ প্রসংগে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ২০ বছরের জন্য ১ শতাংশ হারে সুদে ধার, ঋণ নিচ্ছি এবং আমাদের ইচ্ছেমত ক্ষেত্রেই তা আমরা ব্যবহার করবো।
তিনি বলেন, ‘এই ঋণের টাকা ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটা আমাদের দেশের সম্পূর্ণ নিজস্ব চিন্তা এবং স্বাধীনতা এটুকু আমি বলতে পারি।