প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর সফল হয়েছে : ইনু

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর সফল হয়েছে : ইনু

তথ্য মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সোমবার বলেছেন, ‘তিস্তা চুক্তি হবে’ বলে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ও যৌথ বিবৃতিতে এর উল্লেখ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জোরালো দাবি ও ওকালতির ফসল। এছাড়াও কোন চুক্তিতে কিভাবে দেশ বিক্রি হলো, জানতে চেয়ে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন তথ্যমন্ত্রী।
তিনি বলেন, শেখ হাসিনার ভারত সফর ও ভারতের সাথে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া চিরাচরিত ঢালাও বক্তব্য দিয়েছেন। তার (খালেদা জিয়া) বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে তিনি চুক্তির বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবগত নন, এমনকি চুক্তির শিরোনামগুলোও পড়ে দেখেননি। কোন চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ বিঘ্নিত হলো বা কোন চুক্তিতে দেশ বিক্রি হলো, তাও স্পষ্টকরণ করতে পারেননি।
আজ তথ্য অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তথ্যমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
বহুল আলোচিত প্রতিরক্ষা খাতের ৩টি চুক্তির বিষয়ে তিনি বলেন, চীনের সাথে বাংলাদেশ-চীন প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি-২০০২ সহ রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালীসহ বিভিন্ন দেশের সাথে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়ে ১০টি চুক্তি রয়েছে। বাংলাদেশ তার শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ সামরিক সরঞ্জাম চীন থেকে কিনে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ভারত থেকে সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় আমাদের ক্রয়কে আরো বহুমুখী ও প্রতিযোগিতামূলক করা এবং নির্দিষ্ট কোনো নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসার একটি পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর মান বৃদ্ধি পাবে, যুগোপযোগী চাহিদা পুরণ সহজ হবে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জাতিসংঘে শান্তিরক্ষা মিশনে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্র আরো বিস্তৃত হবে’।
ইনু বলেন, ‘ভারতের সাথে আগে থেকেই সামরিক ক্ষেত্রে যৌথ মহড়া, যৌথ অনুশীলন, উচ্চ পর্যায়ে সফর, প্রতিরক্ষা কলেজগুলোর মধ্যে সহযোগিতা, দুই বছর অন্তর অন্তর প্রতিরক্ষা সংলাপসহ বিভিন্ন সহযোগিতা রয়েছে। চুক্তিগুলোর মাধ্যমে সহযোগিতার বিদ্যমান ক্ষেত্রগুলোকেই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগত রূপ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক একটি কাঠামোগত রূপমাত্র, কোন নতুন বিষয় নয়।’
ভারতকে শত্রু বিবেচনা করা আর ভারতকে প্রতিবেশী বিবেচনা করা, এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য আছে উল্লেখ করে হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘সব বিষয়ে ভারতের সাথে সমঝোতা-সহযোগিতা করা যাবে, কিন্তু সামরিক বা প্রতিরক্ষা বিষয়ে সমঝোতা বা সহযোগিতা করা যাবেনা, এ দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই সেই পাকিস্তানী বস্তাপচা ‘শত্রু-শত্রু খেলা’ দৃষ্টিভঙ্গি লুকিয়ে আছে। চীন, আমেরিকা, রাশিয়া, ইতালী থেকে সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করা যাবে কিন্তু ভারত থেকে সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করা যাবে না। এটাও ঐ রাজনীতির, দৃষ্টিভঙ্গি। সব দেশ থেকে ঋণ নেয়া যাবে, কিন্তু ভারত থেকে ঋণ নেয়া যাবে না, এটাও সেই একই রাজনীতির দৃষ্টিভঙ্গি।’
তিনি বলেন, ‘যারা বলছেন এ সফরে বাংলাদেশ কিছুই পায়নি, তাদের উদ্দেশ্যে বলবো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সফরে সাইবার নিরাপত্তা, পারমাণবিক বিদ্যুৎ, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, স্যাটেলাইট ও মহাকাশ গবেষণার মতো অতিগুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র ও ঋণ সহায়তার বিষয়ে চুক্তির মাধ্যমে দু’দেশের সহযোগিতার ক্ষেত্রে আরো একধাপ অগ্রগতি হলো, উন্নয়নের নূতন দিগন্ত সূচিত হলো।’
চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তাদের চিরাচরিত রাজনৈতিক কায়দা ও ভাষায় চুক্তির বিরোধিতা করে দেশ বিক্রির যে অভিযোগ করেছেন তার জবাবে তথ্যমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমি আপনাদের মাধ্যমে বেগম জিয়াকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত কোন চুক্তি বা সমঝোতা স্মারকটি দেশের স্বার্থ বিরোধী ? কোনটিতে দেশ বিক্রি হয়েছে ? কোনটিতে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হয়েছে ? কোনটিতে বাংলাদেশ তার ভূমির উপর এক সেন্টিমিটার সার্বভৌমত্ব হারিয়েছে ?’।
তিনি বলেন, পাকিস্তান আমল থেকেই ইসলামের নাম ব্যবহার করে ভারতীয় জুজুর ভয় দেখিয়ে ভারত বিরোধিতার নেতিবাচক রাজনীতি চলছে। পাকিস্তান আমলের সেই বস্তাপচা রাজনীতি বেগম খালেদা জিয়া এখনও বহন করে চলছেন।
তিনি বলেন, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর হবার আগে-পরে বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর হলে, ফেনী পর্যন্ত ভারতের দখলে চলে যাবে’।
চুক্তি স্বাক্ষরের কয়েক দিনের মধ্যেই বেগম জিয়া কয়েকশ’ গাড়ির বহর নিয়ে খাগড়াছড়ি পর্যন্ত লং মার্চ করে নিজেই প্রমাণ করেছিলেন তার দেয়া বক্তব্য মিথ্যা। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগেও বিএনপি-জামায়াত বলেছিল, ‘আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় গেলে দেশের মসজিদগুলিতে আজানের বদলে উলুধ্বনি শোনা যাবে’। ‘ভারত দেশ দখল করে নিলো’, ‘ইসলাম গেলো দেশ রসাতলে গেল, ইত্যাদি পাকিস্তানি বস্তাপচা রাজনীতির দুর্গন্ধ ছড়িয়ে রাজনীতির অঙ্গণ সাময়িকভাবে বিষাক্ত করা গেলেও সাধারণ মানুষ এসব মিথ্যাচারে আর বিভ্রান্ত হয় না, বিশ্বাস করে না।
তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারত ভৌগলিক অনিবার্যতায় বাস্তবতা পরিবর্তনের কোন সুযোগ বাংলাদেশ বা ভারতের কারোই নেই। এ বাস্তবতা মেনেই বাংলাদেশ ও ভারতকে চলতে হবে। প্রতিবেশীর সাথে ঝগড়া বাধিয়ে রেখে প্রতিবেশীর কেউই শান্তিতে থাকতে পারে না। সুতরাং প্রতিবেশীর মধ্যে কোন সমস্যা থাকলে তা প্রতিবেশীদের স্বার্থেই সমাধান করতে হবে। সমস্যা জিইয়ে রেখে, ঝুলিয়ে রেখে প্রতিবেশীর সাথে ‘শত্রু-শত্রু খেলা’য় কারোই লাভ হবে না।
তিনি বলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় তৃতীয় পক্ষের হয়ে, পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে ভারতের সাথে ‘শত্রু-শত্রু খেলা’র পাকিস্তানি রাজনীতির ভূতের আছর থেকে বেগম জিয়া, বিএনপি, জামাত এমনকি পন্ডিত-বুদ্ধিজীবী হিসাবে খ্যাতি অর্জনকারী অনেকেই এখনও বের হতে পারেননি। বরং ভারতের সাথে ‘শত্রু-শত্রু খেলা’, ‘ভারতীয় জুজুর ভয়’ দেখানো, ‘ইসলাম গেলো’ ‘ইসলাম গেলো’ বলে রাজনীতিই তাদের প্রধান রাজনৈতিক কৌশল হিসাবেই রয়ে গেছে।’
হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের পক্ষে নন, পাকিস্তানের পক্ষে। তিনি যেমন মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, যুদ্ধাপরাধ ও জঙ্গি-সন্ত্রাস নিয়ে ঢালাও মিথ্যাচার করে আসছেন, তারই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানের চোখ দিয়ে দেখে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কে শত্রুতা জিইয়ে রাখতে চান। খালেদা জিয়া প্রতিবেশীকে শত্রুর কাতারে ফেলে উত্তেজনার বলয়ে ফায়দা লুটতে চান, আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিবেশীকে বন্ধু ভেবে সমস্যা সমাধানে ও সহযোগিতা বৃদ্ধিতে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে চলেন। বাংলাদেশের মানুষ শেখ হাসিনার সাথে রয়েছে’।
প্রতিবেশীর সাথে অনেক সমস্যাই থাকতে পারে। যে সমস্যাগুলির সমাধান সম্ভব তা সমাধানের মাধ্যমে বাকি সমস্যাগুলি সমাধানের পথে হাঁটতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তিস্তার পানি সমস্যার সমাধানে এবার কোনো চুক্তি বা সমঝোতা হয়নি। তিস্তার পানি নিয়ে এখনও জটিলতা রয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তিস্তার পানির দাবি আরও জোরালোভাবেই তুলে ধরেছেন এবং একই সাথে তিনি ভারত-বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন ৫৪টি নদীর পানির প্রবাহ নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থানও জোরালোভাবে তুলে ধরেছেন’।
তথ্য মন্ত্রী বলেন, ১৯৯২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ভারত সফরে গিয়ে গঙ্গার পানি নিয়ে কোনো কথাই বলেননি। দেশে ফিরে আসার পর বিমানবন্দরে সাংবাদিকরা এ বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে, বেগম জিয়া বলেছিলেন, ‘তিনি বিষয়টি ভুলে গিয়েছিলেন’। আর মৃত্যুর মূখে দাঁড়িয়েও শেখ হাসিনা দেশের স্বার্থের কথা ভুলে যান না।
বাংলাদেশ আত্মমর্যাদা নিয়েই ভারতসহ অন্য দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ও সহযোগিতার সম্পর্ক রক্ষা করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ভারত বা কোনো দেশের সাথেই বাংলাদেশ তার কূটনৈতিক সর্ম্পকে একচুল পরিমাণ ছাড় দেয়নি, দিচ্ছে না, দেবেও না।’
কোনো চুক্তিই গোপন নয় উল্লেখ করে তথ্য মন্ত্রী বলেন, ‘সংবিধানের ১৪৫(ক) ধারা অনুযায়ী সরকার চুক্তি করে। চুক্তির পরে সংসদের ভিতরে-বাইরে আলোচনা হতে পারে। এ ছাড়া চুক্তিগুলো গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়ে থাকে।’
দীর্ঘ জাতীয়তাবাদী ও স্বাধীনতা সংগ্রাম, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, ৩০ লক্ষ মানুষের শহীদী আত্মদান, ২ লক্ষ নারীর ওপর নির্যাতন, কোটি কোটি মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীন হয়েছে উল্লেখ করে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘১৬ কোটি মানুষ অতন্দ্র প্রহরীর মতো স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্বের পাহারাদার। মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ কেউই বিক্রি করতে পারবে না, দখলও করতে পারবে না।’

বাংলাদেশ