কানাডায় অবস্থানকারী ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলা’য় মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত পলাতক আসামি এসএইচএমবি নূর চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনতে এবার খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কানাডা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
কমনওয়েলথের সদস্যপদ নবায়ন বিষয়ক কানাডার বিশেষ দূত সিনেটর হুগ সেগাল রোববার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করতে গেলে শেখ হাসিনা এ অনুরোধ জানান।
প্রধানমন্ত্রী কানাডার বিশেষ দূতকে বলেন, ‘কানাডার উচিত বিচারের মুখোমুখি হওয়ার জন্য তাকে (নূর চৌধুরী) বাংলাদেশে পাঠানো।’
কানাডার বিশেষ দূত এ সময় প্রধানমন্ত্রীকে জানান, বিষয়টি তিনি কানাডার যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবেন।
সাক্ষাৎ শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ সাংবাদিকদের এ কথা জানান।
সেনাবাহিনীর এক সময়ের মেজর ও পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের হস্তগত করার বিষয়টি কানাডার সুপ্রিম কোর্টের আওতাধীন হয়ে আছে।
নূর চৌধুরীকে ফেরাতে এর আগে গত ডিসেম্বরে কানাডায় আইনজীবী প্রতিষ্ঠান (ল’ ফার্ম) ট্রয়স এলএলপি নামে কানাডার অন্টারিওভিত্তিক একটি আইনী প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ সরকার।
কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে এ বিষয়ে সহযোগিতা করার জন্য সরকারের তরফ থেকে চিঠিও দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি।
তবে গত ৪ ডিসেম্বর ঢাকায় কানাডার হাইকমিশনার হিদার ক্রুডেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘নূর চৌধুরীকে কানাডা ফেরত দেবে না, কারণ কানাডা এমন কোনো নাগরিককে তার দেশ থেকে বহিস্কার করবে না যিনি নিজ দেশে ফিরে মৃত্যুদণ্ডে জীবন হারাবেন।’
ওই বক্তব্যের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য এক বিবৃতিতে বলেন, ‘একজন আত্মস্বীকৃত খুনীর আশ্রয়স্থল কোনো সভ্য দেশ হতে পারে না।’
রোববারের আলোচনায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জলবায়ূ পরিবর্তন, খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্র্য বিমোচন প্রাধান্য পায়।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিগত ৩ বছরে বাংলাদেশের অর্জিত সাফল্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন সেগাল। বৈঠকে শ্রীলংকায় অনুষ্ঠিতব্য পরবর্তী কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তার সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে কোনো আপোস করবে না।
সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের কোনো দেশ নেই উল্লেখ করে তিনি এসব অপরাধ দমনে সমন্বিত বৈশ্বিক ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বিশেষ দূতকে বলেন, তার সরকার বিগত ৩ বছরে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ কঠোর হস্তে দমন করেছে।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২১ আগস্ট ঢাকায় আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা এবং দেশের ৫শ’ স্থানে একই সময়ে বোমা বিস্ফোরণসহ ব্যাপক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, ওই সময় বর্তমান রাষ্ট্রপতির সহধর্মিনী আইভি রহমান, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া এমপি, ও আহসানউলাহ মাস্টার এমপি নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন।
তিনি বলেন, তার সরকার নির্বাচন কমিশন ও জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করাসহ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরো জোরদার করতে নিরলসভাবে কাজ করছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা ও জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ছাড়া কোনো দেশই কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারে না।
‘তার সরকারের আমলে সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে জাতীয় সংসদের ১২টি আসনে উপ-নির্বাচন এবং সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনসহ সকল নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এসব নির্বাচনের ব্যাপারে কোনো পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ উত্থাপন করা হয়নি।’
অ্যাম্বাসেডর অ্যাট-লার্জ এম জিয়াউদ্দিন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব শেখ এম ওয়াহিদ উজ জামান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামান, প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ ও বাংলাদেশে কানাডার হাইকমিশনার হিথার ক্রুডেন এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
নূর চৌধুরী বৃত্তান্ত:
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালো রাতে নূর চৌধুরী ও মেজর ডালিমের সরাসরি গুলিতে মারা যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত অন্য ঘাতকদের মতো দেশে অবস্থান করেন নূর চৌধুরী। তবে ১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পরের দিন অন্য ঘাতকদের মতো খুনী নূর চৌধুরীও বিশেষ বিমানে ঢাকা থেকে রেঙ্গুন হয়ে ব্যাংকক চলে যান। এরপর পাকিস্তান সরকারের দেওয়া বিশেষ বিমানে তারা লিবিয়া যান।
১৯৭৬ সালের ৮ জুন নূর চৌধুরীসহ ১২ হত্যাকারীকে বিদেশে বাংলাদেশি বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেয় তৎকালীন সরকার।
ইরানে বাংলাদেশ দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি হিসাবে নিয়োগ পান মেজর নূর চৌধুরী। এরপর জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তিনি ব্রাজিলে চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন।
আশির দশকের গোড়ার দিকে এরশাদ সরকারের শাসনামলে নূর চৌধুরী আলজেরিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সেলর হিসাবে নিয়োগ পান। এরপর বেশ কয়েক বছর তিনি জার্মানিতে অবস্থান করেন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে তিনি ভ্রমণ ভিসায় কানাডা চলে যান। সেখানে স্থায়ী বসবাসের জন্য রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন তিনি।
কানাডায় নূর চৌধুরীর স্থায়ীভাবে বসবাসের অন্তত পাঁচটি আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়। ১৯৯৯ সালে প্রম তার আবেদনের ওপর শুনানি হয় এবং প্রাথমিক শুনানিতেই তার আবেদন বাতিল হয়।
ওই সময়েই তাকে ‘ডিপোর্টেশন অর্ডার’ (বহিস্কারাদেশ) দেওয়া হয়। যদিও তিনি আবার আপিল করেন।
২০০২ সালে ওই আপিলের ওপর আরেক দফা শুনানিতেও তার আবেদন গ্রহণ হয়নি। পরে ২০০৪, ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে তার তিনটি আবেদন নাকচ করে দেওয়া হয়।
সর্বশেষ ২০০৭ সালের এপ্রিলে ইমিগ্রেশন অ্যান্ড রিফিউজি আপিল বোর্ড বাংলাদেশের হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার কারণে তার আপিল নাকচ করে দেয়।
আবেদন ও আপিল বাতিল হওয়ার পর ২০০৯ সালের মার্চ মাসে তিনি ওই আবেদনগুলো পর্যালোচনার জন্য ‘প্রি-রিমোভ্যাল অ্যাসেসমন্টে’র কানাডা সরকারের কাছে আবেদন জানান। ওই আবেদনটি এখন শুনানির অপেক্ষায় আছে।
কানাডায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের একটি সূত্র জানায়, কানাডা সরকারের পক্ষে ডিপার্টমেন্ট অব পাবলিক সেফটি নূর চৌধুরীর ব্যাপারে বলেছে যে, কানাডার সুপ্রিম কোর্টের একটি সিদ্ধান্ত নূর চৌধুরীকে বহিষ্কার করা থেকে কানাডা সরকার বিরত আছে। ওই নির্দেশে বলা হয়েছে, ভয়ানক সহিংস কোনও বিদেশি নাগরিক যদি নিজ দেশে ফিরে গেলে মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হওয়ার মতো পরিস্থিতি থাকে তবে তাকে বহিষ্কার করা যাবে না।
নূর চৌধুরীর ব্যাপারে কানাডা সরকারের এই অবস্থানের ব্যাপারেই দেশটির সুপ্রিম কোর্টে আইনী লড়াই করবে সদ্য নিযুক্ত ল ফার্ম ট্রয়স এলএলপি।
নূর চৌধুরীর বহিষ্কারাদেশ ও রাজনৈতিক আশ্রয় আবেদনের ব্যাপারে তাকে আইনী সহায়তা করছেন বারবারা জ্যাকম্যান নামের একজন আইনজীবী।
প্রসঙ্গত, বঙ্গবন্ধুর পলাতক ৬ খুনীকে বাংলাদেশ ফেরাতে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ‘ইন্টারপোল’ ‘ইনফ্রারেড অ্যালার্ট’ নোটিস জারি করেছে। এ ধরনের নোটিস বিশ্বব্যাপী ইন্টারপোলের সর্বোচ্চ নোটিশ।
এসএইচএমবি নূর চৌধুরীর রেড নোটিস নম্বর হলো: এ-১৮৩৬/১-২০০৬।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১২ আসামির মধ্যে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি পাঁচ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তার ফাঁসি কার্যকর হয়। দণ্ডিতদের মধ্যে নূর চৌধুরী ছাড়া বাকি ৫ জন হলেন আব্দুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, আব্দুল মাজেদ ও রিসালদার মোসলেহউদ্দিন।