সিরিয়ায় পাচার হওয়া তিশার গল্প

সিরিয়ায় পাচার হওয়া তিশার গল্প

যৌতুকের দাবি মেটাতে না পারায় মাত্র ১৯ দিনেই সংসার জীবনের ইতি টেনেছিলেন নরসিংদীর ঝিরকুটিয়া গ্রামের তাজমহল আক্তার তিশা। এর পরের যুদ্ধটা একাই লড়তে চেয়েছিলেন। বাবার সংসারে বোঝা না থেকে সচ্ছলতার আশায় বিদেশ পাড়ি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

স্থানীয় দালালের সহায়তায় প্রায় ৭০ হাজার টাকা খরচ করে হাসপাতালের ক্লিনার হিসেবে লেবানন পাড়ি দেন তিশা। সেখান থেকে তিনি এবং তার পরিবারের দুঃস্বপ্ন শুরু।

লেবাননে গৃহকর্তার নির্যাতন সইতে না পেরে কাজ বদলের কথা বলেন তিশা। অন্য বাড়িতে কাজ দেয়ার আশ্বাস দেয় সংশ্লিষ্ট এজেন্সি, কাজও দেয়। একদিন তিশা নিজেকে খুঁজে পান সিরিয়ার কোনো এক বদ্ধ ঘরে। জানতে পারেন মাসিক বেতনের চুক্তিতে নয়, রীতিমত কিনে আনা হয়েছে তাকে। অনেক দিন পর পরিবারকে ফোন করে সবকিছু জানাতে পারলেও পরবর্তী তিন বছর আর কোনো যোগযোগ করতে পারেননি তিশা।

এর মাঝে গ্রাম্য দালালের বিরুদ্ধে মামলা করেন তিশার বাবা মোতালেব মিয়া। কিন্তু সেই দালাল প্রভাবশালী হওয়ায় এবং অভিযোগের পক্ষে তথ্যপ্রমাণ না থাকায় রেহায় পেয়ে যান দালাল বিলাল। এরপর থেকে তিশার পরিবারকে বিভিন্নভাবে হুমকি দিতে শুরু করেন তিনি। জাগো নিউজকে এমন অভিযোগ করেন তিশার মা হাওয়া বেগম।

বছর খানেক আগে সিরিয়া থেকে আবারও ফোন করেন তিশা। দুই মিনিটের সেই ফোনালাপে উদ্ধারের আকুতি জানিয়ে মাকে জানায়, আবারও তিন বছরের জন্য সিরিয়ার আরেক দালালের কাছে তাকে তুলে দেয়া হয়েছে। সেখানেও তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সইতে হয়।

সামান্য খাবার, যুদ্ধ পরিস্থিতি আর নিয়মিত অত্যাচার থেকে বাঁচতে মেয়ের আকুতি নিয়ে সম্প্রতি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দারস্থ হন মোতালেব মিয়া। তিনি জাগো নিউজকে জানান, ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল টিএম ওভারসিজ নামক রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে বৈধভাবে লেবাননে যায় তিশা। হাসপাতালে কাজ দেয়ার কথা বলা হলেও বাড়িতে রেখে তার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালায় গৃহকর্তা। ১৭ দিন পর লেবাননের সেই মালিক তিশাকে সিরিয়ায় অন্য এক মালিকের কাছে বিক্রি করে দেয়। সেখানে তিন বছর কাটানোর পর অপর এক মালিকের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয় তিশাকে। এরই মধ্যে একদিন তিশা বাড়িতে ফোন করে বিস্তারিত জানায়।

এ বিষয়ে টিএম ওভারসিজে যোগাযোগ করা হলে জানা যায় ভিন্ন গল্প। পরিবারের অভিযোগ অস্বীকার করে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার এইচ এম মঈনউদ্দিন তিতাস জাগো নিউজকে জানান, তিশাকে লেবাননে পাঠিয়েছিলাম দুই বছরের চুক্তিতে। সেই চুক্তি শেষ হওয়ার পর তাকে দেশে ফেরার অনুরোধ করা হয়। কিন্তু তিনি দেশে ফিরতে অস্বীকৃতি জানান। এরপর কী হয়েছে আমি জানি না।

তিনি আরও জানান, ওই মালিকের সঙ্গে তিনি সিরিয়া গেছেন নাকি অন্য কোথাও গেছেন- এ বিষয়ে আমি কিছুই বলতে পারব না। কারণ, তার সঙ্গে আমাদের চুক্তি শেষ হয়ে গেছে।

তিশার মতো অনেক বাংলাদেশি নারীকে লেবাননে গৃহপরিচারিকার কাজের কথা বলে সিরিয়ায় পাচার করা হয়েছে। এমন অনেক অভিযোগ মন্ত্রণালয়ের কাছে আছে। ইতোমধ্যে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে লেবাননের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা দিয়ে লেবাননে বাংলাদেশ দূতাবাসকে চিঠি দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

লেবাননের জেনারেল সিকিউরিটি ও শ্রম মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানিয়ে সংশ্লিষ্ট এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ দূতাবাস।

এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, পরিবারের অভিযোগগুলো গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাচারের সঙ্গে কোনো রিক্রুটিং এজেন্সির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বাংলাদেশ