বয়োজ্যেষ্ঠ সুফিয়া বেগম। এক সময় মাটি কেটে ও কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কষ্টে খেয়ে না খেয়ে স্বামী-সন্তানদের নিয়ে দিন পার করতেন। গত ১৭ বছর থেকে সেই কষ্ট লাঘব হয়েছে। সংসারে এসেছে স্বচ্ছলতা। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার পূর্ব বালুভরা গ্রামে আধাপাকা বাড়ি করেছেন ।
শুধু সুফিয়া বেগম নয়। ছাঁট কাপড় থেকে দড়ি তৈরি মঞ্জুয়ারা, পারভিন, সরভান, আছিয়া বেগম, সামাদ আলী, জবদুলসহ অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছেন। উপজেলার পূর্ববালুভরা, উত্তর বালুভরা, দক্ষিণ রাজাপুর, বিষ্ণুপুরসহ প্রায় ১৫টি গ্রামের কয়েক হাজার পরিবার এ দড়ির ওপর নির্ভরশীল। আর এ দড়ি তৈরিকে তারা পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এসব গ্রাম এখন দড়ি গ্রাম হিসেবে পরিচিত।
দড়ি তৈরির সঙ্গে জড়িতরা জানান, কাঠের পাল্লার সঙ্গে বিয়ারিং ও লোহার রড যুক্ত করে দড়ি পাকানোর মেশিন তৈরি করা হয়। এটি খবুই সহজ একটি মেশিন। কাঠ মিস্ত্রি দিয়ে তৈরি করা হয়। আর খুটি হিসেবে ৪/৫ ফুট উচ্চতার দুটি বাঁশ বা কাঠ ব্যবহৃত হয়। খরচও খুবই অল্প।
জানা যায়, ১৯৯৮ সালে উপজেলার ইলশবাড়ীতে ছাঁট কাপড় থেকে দড়ি তৈরি কার্যক্রম শুরু হয়। আর এ দড়ি তৈরির উপকরণ ছাঁট কাপড় চট্টগ্রাম থেকে স্থানীয় পাইকাররা নিয়ে আসেন। প্রতি কেজি ছাট কাপড় ৩০ থেকে ৫০ টাকা দাম। পাইকারদের কাছ থেকে দড়ি তৈরির কারিগররা এসে নিয়ে যান। দড়ি তৈরি করে কারিগররা হাটে-বাজারে খুচরা ও পাইকারী বিক্রি করেন।
ছয়, আট, ১২ ও ১৬ হাত মাপের দড়ি তৈরি করা হয়। এক মণ ছাঁট কাপড় দুই হাজার টাকার মতো বিক্রি হয়। আর লাভ থাকে প্রায় ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। প্রথমে উপজেলার ইলশাবাড়ীতে তৈরি হলেও চাহিদা বাড়ায় এখন উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে তৈরি করা হয় দড়ি। ছাঁট কাপড় থেকে দড়ি তৈরি করতে দুজন কারিগর লাগে। একজন মেশিন দিয়ে পাক দেন ও অপর জন ছাঁট কাপড়গুলো জোড়া দেন। সারা বছরই এ কাজ করা যায়।
ছাট কাপড় থেকে তৈরি দড়ি বেশি টেকসই। এজন্য এ দড়ি পানের বরজে বেশি ব্যবহার করা হয়। আর এ দড়ি পানিতে সহজেই নষ্ট না হওয়ায় চাহিদাও বেশি। কয়েক বছর পর্যন্ত টেকসই থাকে। এ দড়ি বিশেষ করে পাবনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং রাজশাহী জেলায় পানের বরজে ব্যবহার হয়।
সুফিয়া বেগম জানান, সংসারে অভাব থাকায় এক সময় নিজেই ইরি বোরো লাগানোর কাজ করতাম। এক বেলা ভাত হলে অন্য বেলা উপোস থাকতে হতো। কাজ না করলে ভাত জুটতো না। বড় মেয়ে ফাতেমার বয়স যখন দশ বছর তখন দড়ি তৈরির কাজ শিখে। এরপর কাঠ মিস্ত্রী দিয়ে দড়ি পাকানোর একটা মেশিন তৈরি করে ইলশাবাড়ী থেকে ছাঁট কাপড় কিনে দড়ি তৈরি শুরু করেন। পরের বছর গৃহকর্তা মারা যান। সংসারে চার মেয়েসহ পাচঁজন সদস্য। মা মেয়েসহ সবাই মিলে তখন দড়ি তৈরি শুরু করলাম।
Naogaon2
তিনি আরও জানান, দড়ি বিক্রি করে যখন লাভ আশা শুরু হয় তখন বেসরকারি সংস্থা থেকে টাকা ঋণ নেয়া হয়। আর লাভ থেকেই ঋণ পরিশোধ করা হয়। এরপর দড়ির চাহিদা বেড়ে যায়। কাজও বেড়ে যায়। টাকা আয় হতে থাকে। নিজের উপার্জিত টাকা দিয়ে ৮/৯ বছর আগে চার শতাংশ জমির ওপর আধা পাকা ইটের বাড়ি করা হয়। এতে প্রায় আড়াই লাখ খরচ হয়। দড়ি তৈরি করে সংসারে ফিরেছে স্বচ্ছলতা। দড়ি তৈরি করে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। এখন আর মাঠে কৃষি কাজ করতে হয় না। আল্লাহর রহমতে ভালো আছি।
একই গ্রামের গৃহবধূ পারভিন আকতার বলেন, গত চার বছর থেকে দড়ি তৈরির কাজ করছেন। সংসারে কাজের পাশাপাশি এ কাজ করেন। এ থেকে বাড়তি অর্থ নিজের ও সংসারের কাজে ব্যয় করেন। আগে দাম ভালো ছিল। এখন কিছুটা দাম কমেছে। তবে মওসুমে দাম বৃদ্ধি পায়। এ হস্তশিল্পে সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষুদ্র ঋণ দেয়া হলে এর প্রসার বৃদ্ধি পাবে।
ছাঁট কাপড় ব্যবসায়ী হাসু বলেন, ছাঁট কাপড় থেকে দড়ি তৈরি করে অনেকেই তাদের অভাব দূর করেছেন। কারিগররা বিভিন্ন গ্রাম থেকে ছাঁট কাপড় নিয়ে যান।