বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিতে আইন যথাযথ প্রয়োগের আহবান প্রধানমন্ত্রীর

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিতে আইন যথাযথ প্রয়োগের আহবান প্রধানমন্ত্রীর

আইনের যথাযথ প্রয়োগ ঘটিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাঁর সরকার দেশের উচ্চশিক্ষার প্রসারে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ইতোমধ্যে আমরা ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০’ করে দিয়েছি, এই আইন যাতে যথাযথ প্রয়োগ হয়, সেদিকে সকলের নজর দিতে হবে।’ তিনি বলেন, সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যথাযথ মনিটরিং করতে ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন আইন-১৯৭৩’ সংশোধন করার কাজ চলছে। তিনি বলেন, ‘আসলে মঞ্জুরি কমিশন যে অবস্থায় আছে তা দিয়ে ১৩৭টি বিশ্ববিদ্যালয়কে নজরদারিতে রাখা সম্ভব নয়।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার তাঁর তেজগাঁওস্থ কার্যালয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) প্রদত্ত ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক-২০১৩ ও ২০১৪’ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ সব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানের বক্তব্যের আলোকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটা ঠিক আমাদের মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান বলেছেন, আমাদের সরকারি-বেসরকারি মিলে এতোবেশি বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেছে সেগুলো নজরদারি করা সত্যই খুব কষ্টকর। এতে কোন সন্দেহ নেই। দেশে ৯৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা হচ্ছে ৪২টি।’
তিনি বলেন, ‘কাজেই ’৭৩ সালের মঞ্জুরি কমিশন আইন যেটা সংশোধনের একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে সেটার যথাযথভাবে কাজ হচ্ছে আমার মনে হয় এটা করে দিতে হবে। না করলে পরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কি পড়াশোনা হচ্ছে কি চলছে এগুলো ভালভাবে নজরদারি করা যাবে না। আমরা এই আইনটা সংশোধন করে দেব। এতে আর কোন সন্দেহ নেই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এডুকেশন কাউন্সিলও আমরা করে দিয়েছি। এ ধরনের বিভিন্ন পদক্ষেপ আমরা ইতোমধ্যে নিয়েছি- আমাদের লক্ষ্যটা হচ্ছে দেশের উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়ন। এ জন্যে ‘উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্প (এইচইকিউইপি)’ এটাও আমরা বাস্তবায়ন করে দিয়েছি।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। ইউজিসি’র সদস্য অধ্যাপক দিল আফরোজা বেগম অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক প্রাপ্তদের পক্ষ থেকে জেনিফার হাকিম লুপিন এবং স্বজন রহমান তাদের নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্ত করেন।
অনুষ্ঠানে দেশের সকল প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের শীর্ষস্থান অধিকার করা কৃতি ২৩৩ জন শিক্ষার্থীর মাঝে ইউজিসি পদত্ত প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক ও সনদপত্র বিতরণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে ৫৬ জনের হাতে পদক তুলে দেন।
মন্ত্রিপরিষদ সদস্যগণ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্ঠাগণ, সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা, বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যবৃন্দ, উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি বৃন্দ এবং স্বর্ণজয়ী শিক্ষাথীবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

দেশের বিভিন্ন জেলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বল্পতার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের প্রতিটি জেলাতেই অন্তত একটি বিশ্ববিদ্যালয় যেন হয় সে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় হয় সরকারি, না হয় বেসরকারি হবে। তবে, অবশ্যই এটা মানসম্পন্ন হতে হবে। আমরা সেভাবেই পদক্ষেপ নিচ্ছি। বেসরকারিভাবে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য যারা অনুমতি চাইতে আসেন, তখন আমি নিজেই এক একটি জেলা নির্দিষ্ট করে দিচ্ছি কোথায় বিশ্ববিদ্যালয় করতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের ছেলে-মেয়েরা যেন ঘরে খেয়ে বাবা-মার সঙ্গে থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করতে পারে তার ব্যবস্থাও আমরা করে দিচ্ছি।
শেখ হাসিনা বলেন, এছাড়া প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কলেজ স্থাপন বা পুরনো যে কলেজগুলো আছে সেগুলি সরকারিকরণ করে দিচ্ছি। এভাবে এ পর্যন্ত ৩৬৫টি কলেজ আমরা সরকারিকরণ করেছি।
শিক্ষাখাতের উন্নয়নে সরকারের পদক্ষেপের তথ্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কেবল গতকালই আমরা শিক্ষা খাতের উন্নয়নে এক লাখ কোটি টাকার ওপরে ব্যয় সম্পন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছি। এ টাকায় প্রি-প্রাইমারী থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত প্রকল্প গ্রহণ করা হয় এবং গতকালের অধিকাংশ প্রকল্পই অনুমোদিত হয়েছে শিক্ষা বিষয়ক। যেহেতু শিক্ষা বিষয়ক প্রকল্প- এ জন্য যত টাকাই লাগুক আমরা অনুমোদন করে দিয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধিকে তার একটা বিনিয়োগ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, এই প্রকল্পগুলো শেষ হতে প্রায় ২০২১ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে। এর ফলে প্রি-প্রাইমারী থেকে উচ্চশিক্ষা খাতে বিভিন্ন বিশ্ববিদালয় এবং ইনস্টিটিউটগুলো সবই মানোন্নয়ন হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার উচ্চশিক্ষার জন্য নির্দিষ্ট স্থানে ল্যাবরেটরি স্থাপন এবং বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, ডিজিটাল যন্ত্রপাতি এসবের দিকেই আমরা গুরুত্ব দিয়েছি। আল্লাহর রহমতে বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্ট সাবলম্বী, কাজেই সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমাদের যে অর্থসম্পদ তার বেশিরভাগই আমরা শিক্ষা খাতে ব্যয় করছি। এটাকে আসলে আমি ব্যয় মনে করি না এটা হচ্ছে একটা বিনিয়োগ, সবচেয়ে বড়ো বিনিয়োগ। যা জাতিকে গড়ে তুলবে। মেধার বিকাশ হবে এবং আজকে আমাদের মেধাবী ছেলে-মেয়েরা আরো চিন্তা করবেন কিভাবে দেশকে আরো এগিয়ে নেয়া যায়। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে কিভাবে আমরা টিকতে পারবো।
প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক বিজয়ীদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, আজকে যারা নিজ নিজ বিভাগে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে স্বর্ণপদক পেয়েছে তাদের জন্য একটা দায়িত্বও বেড়ে গেল। আমি বলব যে, অনেক বড়ো দায়িত্ব।
প্রযুক্তি ব্যবহারে তাঁর সরকার অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান এবং বাংলাদেশকে দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবলের সঙ্গে যুক্ত করায় তাঁর সরকারের পদক্ষেপের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শিক্ষার প্রতি যে গুরুত্বারোপ করে গেছেন সে অনুয়ায়ী আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে-আমাদের জীবন মানও উন্নত হতে হবে। একই সাথে এই শিক্ষাটাকে দেশের মানুষের কল্যাণে কিভাবে লাগানো যায় সেটাও চিন্তা করতে হবে। নিজের অর্থ চিন্তা করলে হবে না।
কর্মসংস্থানের বহুমুখী পদক্ষেপ তার সরকার হাতে নিয়েছে এবং পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের মধ্যদিয়ে পরমাণু যুগে প্রবেশ ঘটায় আমাদের আরো দক্ষ কারিগরি বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী ও গবেষক প্রয়োজন রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। গবেষণাকে তাঁর সরকার অধিক গুরুত্ব দিলেও ৯৬ পূর্ববর্তী সরকারগুলো কাছে গবেষণার কোন গুরুত্ব না থাকায় বাজেটে কোন বরাদ্দ ছিলনা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৯৬ সালে প্রথম বাজেটে আমরা গবেষণার জন্য প্রথম একটা থেকে বরাদ্দ দিলাম তারপরের বাজেটে একটি আলাদা টাকাই রেখে দিলাম, যেটা গবেষণার জন্য ব্যয় হবে। সে সময় তাঁর সরকার গবেষণায় গুরুত্ব দিয়েছিল বলেই বাংলাদেশ আজ খাদ্যে উদ্বৃত্ত দেশ, উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
কারিগরি ক্ষেত্রে এখনো দক্ষ লোক ভাড়ায় আনতে হয় মর্মে আক্ষেপ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কেন আমাদের হায়ার করতে হবে। …আমাদের ছেলে-মেয়েরা অত্যন্ত মেধাবী। তাদের সেই মেধা বিকাশের সুযোগটা আমাদের দেশের মধ্যেই করে দিতে হবে। আর সেইদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছি।’ তিনি বলেন,সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বে মাঝে মাঝে নতুন নতুন উপসর্গ শুরু হয়। আজকে আবার একটা নতুন উপসর্গ এসে গেছে সেটা হচ্ছে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ।
‘মেধাবী শিক্ষার্থী, উচ্চবিত্ত ছেলে-মেয়েরা কিভাবে ধর্মান্ধ হয়ে যায়, আর কিভাবে এই জঙ্গিবাদের পথে যায়, এটা আমার কাছে বোধগম্য না। ..আত্মঘাতী হওয়া- আমাদের ইসলাম ধর্মে এমনিতেই বলে, আত্মহত্যা মহাপাপ। সেই মহাপাপের পথে কি করে যায়, ধর্মের নামে। এটা আমাদের দেশে কেবল নয়, বিশ্বব্যাপী আরো বেশি’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখানে প্রশ্ন হচ্ছে কারা এদের টাকা দিচ্ছে, অস্ত্র দিচ্ছে, কারা এদের উৎসাহিত করছে ?
প্রধানমন্ত্রী বলেন, উন্নত দেশে পড়াশোনা করতে গিয়ে জাঙ্গিবাদের পথে চলে যাচ্ছে। আমাদের দেশেও কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। সে ক্ষেত্রে আমি বলব, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যারা শিক্ষক, তাদের ছেলে -মেয়েরা কোথায় যাচ্ছে, তারা কি করছে, ক্লাশে অনুপস্থিত থাকছে কিনা এ বিষয়ে প্রত্যেককে লক্ষ্য রাখতে হবে। যাতে করে এ ধরনের বিপথে আর কেউ যেতে না পারে।
তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশের মানুষ ধর্ম পালন করি, বিশ্বাস করি, আমরা ধর্মভীরু কিন্তু ধর্মান্ধ না। এই ভূখন্ডে যার যার ধর্ম সে সে পালন করেবে সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়েই বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে এবং এই অঞ্চলে সে ধরণের একটি সম্প্রীতি নিয়েই আমরা চলি। এই যে উগ্রবাদ জঙ্গিবাদ, এ থেকে সকলকে ফিরিয়ে আনতে হবে। আর একটি হচ্ছে মাদকাশক্তি। এর কবল থেকে আমাদের ছেলে-মেয়েকে উদ্ধার করতে হবে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুদায়িত্ব আমাদের অভিভাবকদের, তারপরে শিক্ষকদের।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং তাঁর যে দূরদর্শিতা আমরা দেখি, এই দূরদর্শিতাই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবার পক্ষে অনেক বেশি সহায়ক। পৃথিবীর অন্যাান্য দেশের সঙ্গেও যা দরকার তা তিনি করে গেছেন খুব অল্প সময়ের মধ্যে, মাত্র সাড়ে ৩ বছরে।’
তিনি বলেন, ১৯৭৪ সালে সমুদ্র আইন করে সমুদ্রসীমায় আমাদের যে অধিকার সে অধিকার তিনি নিশ্চিত করে গিয়েছিলেন। কিন্তু ’৭৫ পর সরকারগুলো কেউ এ ব্যাপারে কোন উদ্যোগ নেয়নি। আমি যখন ’৯৬ সালে সরকারে আসি তখন এই বিষয়টা নিয়ে কাজ শুরু করেছি।
সমুদ্রসম্পদ আমাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে প্রয়োজন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই সম্পদ আমাদের অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখতে পারে। সেখানেও আমাদের গবেষণা দরকার। সেজন্য আমরা একটি রিসার্স ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছে, সেখানে একটি সী অ্যাকুরিয়ামও করতে চাই। এটা বিশাল ব্যাপার, কিন্তু এটা করলে আমাদের সমুদ্র গবেষণা আরো সহজ হবে।

বাংলাদেশ শীর্ষ খবর