চারুকলার শোভাযাত্রা : রাজধানীর বৈশাখী ঐতিহ্য

চারুকলার শোভাযাত্রা : রাজধানীর বৈশাখী ঐতিহ্য

পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ; শুরু হচ্ছে বঙ্গাব্দ ১৪১৯। সবাই গলা ছেড়ে গাইবো কবিগুরুর সেই বিখ্যাত গান ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো…’। পহেলা বৈশাখ ছাড়া বাঙালীর এতবড় সার্বজনীন উৎসব আর নেই। বিদায়ী বছরের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, হতাশা-ক্লান্তি, বেদনা-হাহাকারের পালা সাঙ্গ করে নতুন উদ্দীপনায় অসাম্প্রদায়িক চেতনার গান নিয়ে নতুন বছরকে বরণ করছে বাঙালী জাতি।

বাংলা নববর্ষ বাঙালীর প্রাণের উৎসব। এদিনটিতে সারা বিশ্বের বাঙালীরা পুরোনো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করতে উৎসবে মেতে উঠে। স্থান, কাল, পাত্র ভেদে এই উৎসবের ধরণ ভিন্ন ভিন্ন হয়। একেক অঞ্চলে একেক রকম আয়োজনে উদযাপিত হয় বৈশাখী মেলা, হালখাতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নৃত্যানুষ্ঠান, চৈত্র সংক্রান্তী ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। তবে রাজধানী ঢাকায় প্রতি বছর নববর্ষের দিনের প্রধান আকর্ষণ হিসেবে থাকে ‘মঙ্গল শোভা যাত্রা’।

রাজধানীতে নববর্ষের অন্যতম বিশেষ আয়োজন হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে বের হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রা। প্রতিবারই  বাংলা নববর্ষকে বর্ণিল আয়োজনে বরণ করে নিতে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয় চারুকলায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয় নি। এবছর মাস্টার্স এগারোতম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের নের্তৃত্বে চারুকলার সব শিক্ষার্থীরা সম্মিলিতভাবে শোভাযাত্রার প্রস্তুতি নিয়েছে। সার্বিক তত্বাবধানে রয়েছে একটি কমিটি। যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন চারুকলার শিক্ষক শিশির ভট্টাচার্য, নেসার হোসেন, আবুল বারক আলভি প্রমুখ। পহেলা বৈশাখে সকাল নয়টার দিকে চারুকলা থেকে এই মঙ্গল শোভাযাত্রাটি বের হয়ে হোটেল রূপসী বাংলার (সাবেক শেরাটন হোটেল) সামনে দিয়ে ঘুরে সোজা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে যাবে। সেখান থেকে আবার শোভা যাত্রাটি চারুকলার সামনে এসে শেষ হবে।

জানা যায়, নরসিংদীর ওয়ারীর বটেশ্বর প্রমাণ করে বাঙালীর সভ্যতা আড়াই থেকে তিন হাজার বছরেরও প্রাচীন। আর এ ইতিহাসের রয়েছে অনেক চড়াই-উতরাই। সে বিবেচনায় এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার থিম নির্ধারণ করা হয়েছে ‘বাংলার ইতিহাসের নেগেটিভ ও পজিটিভ দিক’। এর মধ্যে রয়েছে সাশান (বাংলাদেশের সামুদ্রিক সিমানা জয়), অপশক্তির বিরদ্ধাচারন, হাতী, ঘোড়া ও পাখী। এই থিমকে ধরেই শোভাযাত্রার প্রতীক তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

প্রথম শোভাযাত্রা চালু হওয়ার বিষয়ে জানা যায়, ১৯৮৮ সালের যশোরের চারুপীঠ নামক একটি প্রতিষ্ঠান সর্বপ্রথম এরকম একটি শোভা যাত্রার আয়োজন করে। তৎকালীন স্বৈরশাসকের সময় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় তার প্রতিবাদে সেই শোভা যাত্রাটির আয়োজন করা হয়। সে সময় শোভা যাত্রাটির মূল উদ্যেক্তা ছিলেন মাহবুব জামিল শমিম, হিরন্ময় চন্দ, মোখলেসুর রহমান। এর  পরের বছর ১৯৮৯ সাল থেকে খুব অল্প পরিসরে চারুকলার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিজস্ব অর্থায়নে প্রতি বছরই ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ উৎসবটি করে থাকে।

চারুকলার আয়োজনে প্রথম শোভাযাত্রার উদ্যোক্তা উপদেষ্টা ছিলেন- শিল্পী ইমদাদ হোসেন, রফিকুননবী (রনবী), আবুল বারাকাত আলভী, ওয়াহিদুল হক, ফয়েজ আহমেদ, নাসিরদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। তৎকালীন শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন- নেসার হোসেন, শিশির ভট্টাচার্য, এম মনিরুজ্জামান, সাখাওয়াত, কামাল পাশা চৌধুরী, বিপুল শাহ। তবে আগে অল্প পরিসরে হলেও ২০০০ সালের দিকে এসে এর পরিসর বাড়তে থাকে।

পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রার উৎসবটি সফলভাবে সম্পন্ন করতে মোটা অংকের বাজেটও লাগে। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত শোভাযাত্রার জন্য চারুকলা কখনোই স্পন্সর নেয়নি। অর্থ সংগ্রহের জন্য শিক্ষার্থীরা বাঙালী সংস্কৃতির নানা বিষয় রং-তুলির আঁচড়ে তুলে ধরেন মাটির সরায়, ক্যানভাসে ও মুখোশে। শিক্ষকদের কাছেও রংতুলি ও পেপার পাঠানো হয়। শিক্ষকরা ছবি এঁেক পাঠিয়ে দেন। তাঁদের আঁকা ছবি বিক্রি করেও অর্থ সংগ্রহ করা হয় উৎসবের জন্য। শিক্ষকদের চিত্রকর্ম সর্বনিম্ন আড়াই হাজার টাকা করে বিক্রি করা হয়ে থাকে। তবে আরও বেশি দামের চিত্রকর্মও রয়েছে। আর শিক্ষার্থীদের আঁকা ছবি এক হাজার ও পাঁচ’শ টাকা করে বিক্রি করা হয়। এছাড়া লোকজ মোটিভ সম্বলিত সরার মধ্যে ছোট সরা ৩শ‘ ও বড় সরা পাঁচ’শ টাকা করে এবং মুখোশ ৬’শ টাকা করে বিক্রি করা হয়।

শোভাযাত্রার অর্থায়নের জন্য চারুকলায় আরো  বিক্রি করা হয় – মুখোশ, জল রং, সরা পেইটিং, টি শার্ট, তুলার পাখি ইত্যাদি। পঞ্চাশ টাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন দামে এসব জিনিস ক্রেতা সাধারন কিনতে পারেন। তবে শিক্ষকদের কাজ এবং আরও বিশেষ কিছু কাজ নিলামের মাধ্যমে প্রতি বছর বিক্রি হয় বলে জানান, এগারোতম ব্যাচের ছাত্র মিথুন দত্ত। তিনি বলেন, বাঙালী সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী আপাদমস্তক বাঙালীরা বাংলা নববর্ষের এই উৎসবকে স্বার্থক করে তুলতে তাদের আঁকা সরা, ছবি, মুখোশ এবং তাদের শিক্ষকদের আঁকা ছবি ক্রয়ের মাধ্যমে ফান্ড তৈরিতে সহায়তা করে। শোভাযাত্রার প্রতীক তৈরিতে এবার ফোক মোটিভ হিসাবে তিন পাখির একটি কম্পোজিশন তৈরির কাজ হয়েছে।

বিনোদন