‘সিলেটের কলেজছাত্রী খাদিজা বেগম নার্গিস অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া এক জীবন্ত কিংবদন্তী নারী। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত পাষণ্ড প্রেমিকের চাপাতির নৃশংস আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত খাদিজা দীর্ঘদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে মৃত্যুর কাছে হেরে না যাওয়া সমগ্র বিশ্ব নারী সমাজের প্রতিভূ, বিজয়িনী, প্রতিবাদকারিনী।
বুধবার দুপুরে সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক আকবর হোসেন মৃধা খাদিজা হত্যাচেষ্টা মামলার ৩০ পৃষ্ঠার রায়ের পর্যবেক্ষণে এসব কথা বলেন।
এরপর কলেজছাত্রী খাদিজা বেগম নার্গিসকে হত্যাচেষ্টা মামলায় একমাত্র আসামি বদরুল আলমকে দণ্ডবিধির ৩২৬ ধারায় দোষী সাবস্ত করে সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। একই সঙ্গে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো দুই মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়।
খাদিজার ওপর হামলার ভয়াবহতা বুঝাতে মামলার ৩৩ নম্বর সাক্ষী স্কয়ার হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক রেজউস সাত্তারের সাক্ষ্যের ব্যাখা দিয়ে আদালত বলেন, আসামি খাদিজার শরীরের ১০টি স্থানে ধারালো অস্ত্র দিযে মারাত্মক জখম করেছেন। এর মধ্যে তার মাথার ডান পাশের খুলির একটি অংশ ভাঙা পান চিকিৎসকরা। পরে তারা একাধিক অপারেশনের মাধ্যমে মাথার খুলির ওই অংশ প্রতিস্থাপন করেছেন।
আদালত রায়ে বলেন, এই ঘৃণিত অপরাধের জন্য দণ্ডবিধির ৩২৬ ধারায় আসামি বদরুলের সর্বোচ্চ সাজাই প্রাপ্য। তাই তাকে এই আইনে সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হলো।
আদালত বলেন, মামলার অপর দুই ধারা ৩২৪ ও ৩০৭ ধারায় যেহেতু সাজার মেয়াদ কম তাই এই ধারাগুলোয় অপরাধ প্রমাণ হওয়ার পরও তাকে আর সাজা দেয়ার প্রয়োজন নেই।
পর্যবেক্ষণে বিচারক আরো বলেন, আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এই দিবসেই সবার সংকল্প করা উচিত নারীরাও সমাজের উন্নয়নে অর্ধেক ভুমিকা রাখছেন। তাই তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সরকার, আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীসহ সবার দায়িত্ব। যেভাবেই হোক নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নারীদের প্রতি তাদের প্রাপ্য সম্মান দেখাতে হবে।
দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেত্রী, মন্ত্রী, বিচারকও নারী। তাঁরা নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সফলভাবে দেশের কল্যাণে ভুমিকা রাখছেন। গার্মেন্টেস শিল্পকে নারীরাই এগিয়ে নিচ্ছেন। দেশের অর্থনীতিকে তারা সচল রেখেছেন। তাই নারীদের অবহেলার সুযোগ নেই। নারীর ক্ষমতায়নে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
আলোচিত এই ঘটনার পাঁচ মাস পাঁচদিনের মাথায় মাত্র নয় কার্যদিবসে বিচার কার্যক্রম শেষে আদালত থেকে এই রায় এলো। রায় ঘোষণার সময় আদালতের কাঠগড়ায় খাদিজার ওপর হামলাকারী বদরুল উপস্থিত ছিলেন।
গত বছরের ৩ অক্টোবর এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে গরুর মাংস কাটার চাপাতি দিয়ে খাদিজাকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার মনিরজ্ঞাতি গ্রামের বাসিন্দা বখাটে বদরুল।
আধাঘণ্টা ব্যাপী রায় ঘোষণাকালে আদালতে উপস্থিত ছিলেন- মামলার একমাত্র আসামি বদরুল আলম। বাদি খাদিজার চাচা আব্দুল কুদ্দুস আদালতের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে রায় উচ্চ আদালতেও বহাল থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন।
আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এই দিবসে খাদিজাকে নৃশংস ও বর্বরোচিতভাবে কোপানোর অভিযোগে আসামি বদরুলের যথোপযুক্ত শাস্তি নারীদের সুরক্ষায় তাৎপর্যপূর্ণ ও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
রায়ে আরো বলা হয়, মানবজীবনে প্রেম-ভালোবাসা চিরন্তন। প্রেম-ভালোবাসায় মিলন, বিরহ থাকবেই। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হলে এমন পৈশাচিক, নৃশংস ও নির্মম হামলা মোটেই কাম্য এবং আইন সমর্থিত নয়।
আদালত বলেন, সাক্ষীদের সাক্ষ্য থেকে ঘটনার সঙ্গে আসামি বদরুলের সম্পৃক্ততা অবিশ্বাস করার মতো কোনো সাক্ষ্য আমি পাইনি। উপর্যুপরি ১০টি আঘাতের ধরণ এবং আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে চাপাতি কিনে আনার ঘটনা প্রমাণ করে, খাদিজাকে খুন করার পরিকল্পনা আসামির ছিল। কাজেই আমি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি, রাষ্ট্রপক্ষ আসামির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে।