মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি ভিসারেভের বিরুদ্ধে প্রতারিত গ্রাহকরা অভিযোগ এনেছেন। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ৪৩ লাখ টাকা প্রতারণা করার অভিযোগ এসেছে। তবে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভিসারেভের উদ্যোক্তারা প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে।
সম্প্রতি প্রতারিত ১৫ ব্যক্তি বাংলাদেশ ব্যাংকে লিখিতভাবে অভিযোগ করেছেন। অভিযোগকারীদের সবাই সিলেটের বাসিন্দা। এ বিষয়ে একটি মামলাও হয়েছে আদালত।
কোম্পানিটি সিলেট ও চট্টগ্রামের প্রায় ৩০ সহস্রাধিক বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে বড় অংকের টাকা প্রতারণা করেছে। বিনিয়োগকারীরা জানিয়েছেন, উদ্যোক্তারা প্রায় সাড়ে তিনশ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হয়ে গেছে।
অভিযোগে বলা হয়েছে, বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে উল্লিখিত কোম্পানি বিনিয়োগ চায়। বিজ্ঞাপনগুলো দেওয়া হয়েছিলো প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে। তারা সেখানে বলে, তাদের মাধ্যমে টাকা বিনিয়োগ করলে ১০ মাসে টাকা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। তাতে আকৃষ্ট হয়ে ঐ প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে তারা বিভিন্ন অংকে টাকা বিনিয়োগ করে। ২০১০ সালের নভেম্বরে এখানে কেম্পানির অ্যাকাউন্টে টাকা জমা করেন গ্রাহকরা। ২০১১ সালে মুনাফাসহ অর্থ ফেরত পাওয়ার কথা ছিল।
জানা গেছে, দুদক এ ব্যাপারে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে এসে মামলা দায়ের করে। এরই প্রেক্ষিতে চলতি বছর জানুয়ারিতে আদালত ভিসারেভ ও ইউনিগেট ওয়ে-২ ইউ-এর হিসাব জব্দ করার আদেশ দেন।
জানা গেছে, বর্তমানে ভিসারেভ কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হয়ে গেছে। চট্ট্রগামেও তাদের কোনো কার্যক্রম নেই। আত্মগোপনে থাকা উদ্যোক্তাদের অনেক চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
সূত্র জানায়, ভিসারেভ চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে কার্যক্রম শুরু করে। বেশ কিছু মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। কিন্তু পরে ইউনিপে-২-এর বিরুদ্ধে যখন আন্দোলন শুরু হয়, তখন তারা অফিস বন্ধ করে দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়।
চট্টগ্রামে ভিসারেভের তিনটি এজেন্ট অফিস ছিল। এগুলো বহদ্দারহাট, জিইসি মোড় ও আগ্রাবাদে। ২০১০ সালে তিন মাস ভিসারেভ এসব অফিসের মাধ্যমে কার্যক্রম চালায়। এসময়ে তাদের প্রায় পাঁচ শতাধিক বিনিয়োগকারী হয়। সব মিলিয়ে তারা চট্টগ্রাম থেকে আনুমানিক প্রায় পাঁচ থেকে ছয় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
নয়ন নামের চট্টগ্রামের একজন বিনিয়োগকারী জানান, তিনি দুই লাখ ১২ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন। সেই টাকা তিনি আর ফেরত পাননি।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে ভিসারেভ চালাতেন মোস্তফা আমীন নামের একজন ব্যবসায়ী। তিনি যুবলীগের রাজনীতি করতেন।
সিলেটের করেসপন্ডেন্ট জানান, সিলেটে ডা. রিপন নামে এক ব্যবসায়ী এটি পরিচালনা করতেন। কিন্তু সিলেটের করিমুল্লাহ মার্কেটের পঞ্চম তলায় এর অফিস ছিল। কিন্তু বর্তমানে সেখানে একটি বীমা কোম্পানির অফিস রয়েছে। সিলেটের প্রায় ৩০ হাজার বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে আনুমানিক ৩০০ কোটি টাকা প্রতারণা করে নিয়েছে ভিসারেভ। বিনিয়োগকারীদের বেশির ভাগই যুবক। বিনিয়োগ হারিয়ে এসব যুবক এখন দিশেহারা। তবে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে ডা. রিপনের মোবাইল ফোনে চেষ্টা করে বন্ধ পাওয়া গেছে।
জালাল নামের আরেকজন বিনিয়োগকারী বলেন, তিনি দুই লাখ টাকা বিনিয়োগ করে কোনো টাকা ফেরত পাননি। সিলেটে ১৫টি এজেন্টের মাধ্যমে ভিসারেভ তার ব্যবসা পরিচালনা করত। প্রথমে তারা আবাসিক হোটেলগুলোয় কার্যক্রম শুরু করে। পরে বিভিন্ন এলাকাতে অফিস ভাড়া নিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যায়। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও নগদ দুইভাবেই লেনদেন করত। তবে নগদ লেনেদেনের ক্ষেত্রে কোনো প্রমাণ কপি দিতো না তারা।
এদিকে, প্রতারিত ব্যক্তিদের একটি দল সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকে লিখিতভাবে অভিযোগ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, বিষয়টি যেহেতু আদালতে গড়িয়েছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু করার নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত করবে কি না সেটা ভাবছে। তবে সেটি সম্ভব নাও হতে পারে।
অভিযোগকারী ব্যক্তিরা সবাই সিলেটের বাসিন্দা। ১৫ অভিযোগকারী হচ্ছে, নাইমুল ইসলাম, দীপক কুমার দেব, আল ইমরান, আসাদুজ্জামান, মহসিন আহমদে চৌধুরী, সত্তরন চন্দ্র দাস, বখতিয়ার হোসেন, মোহাম্মদ খসরু আহমেদ, মোহাম্মদ শফিক, রঞ্জন ভট্ট, চন্দন কুমার দত্ত, নমিতা পাল, সুজিত চক্রবর্তী, সৌরভ রায় ও সামিয়া মাহরীন।
অভিযোগকারী নাইমুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ভিসারেভের বিজ্ঞাপন দেখে সেখানে সাড়ে চার লাখ টাকা বিনিয়োগ করি। কোম্পানিটি বলেছিলো, ১০ মাস পরে দ্বিগুণ অর্থ ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু তা পেলাম না।’ আরো অনেক ব্যক্তির কাছ থেকে ঐ প্রতিষ্ঠান টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, ‘আমাদের টাকা ফেরত দেওয়ার সময় তারা নানান টালবাহানা করতে থাকে। এক পযায়ে অফিসে তালা দিয়ে পালিয়ে যায়।’ ইতোমধ্যে সংস্থাটির ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
ভিসারেভের অবৈধ লেনদেন হয়েছে মূলত ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড ও অন্য একটি ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে।