১৯৭১ সালে গণহত্যা নিয়ে পাকিস্তানিরা অপপ্রচার চালাচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলেছেন, বাংলাদেশেও বিএনপি নেত্রী যে শহীদের সংখ্যা নিয়ে মন্তব্য করেছেন, তার সঙ্গে এই অপপ্রচারের মিল থাকতে পারে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে দেশের ১৭ জন বিশিষ্ট নাগরিককে একুশে পদক প্রদান অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
ব্রিটিশ শাসনামল থেকে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম এবং বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিদের অত্যাচার নির্যাতনের কথা বলতে গিয়ে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও পাকিস্তানিদের চক্রান্ত শেষ হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা নতুনভাবে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। গণহত্যার ছবিতে মুক্তিযোদ্ধারা হত্যা করেছে বলে তারা প্রচার শুরু করেছে। তারা রিপোর্ট তৈরি করে সব জায়গায় প্রচার করার চেষ্টা করছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এখন আমরা স্বাধীন দেশ, অর্থনৈতিকভাবে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। বিশ্বে বাংলাদেশ আজ রোল মডেল, বাংলাদেশ এখন মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। এ সময় এ ধরনের অপপ্রচার তারা করে যাচ্ছে, এটা কারও কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।’
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে শুরু হওয়া গণহত্যার স্মরণে ওই দিনটিকে গণহত্যা দিবস হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার কথা জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘জঘন্য ঘটনা তারা ঘটিয়েছিল, দিনের পর দিন তারা হত্যা করেছিল। ৩০ লক্ষ মানুষ তখন জীবন দিয়েছে, দুই লক্ষ মা-বোন ইজ্জত দিয়েছে। এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য।’
এই পর্যায়ে এসে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার দুই বছর আগের একটি কথার সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। ২০১৫ সালের ২১ মার্চ বিএনপির এক সহযোগী সংগঠনের আলোচনায় খালেদা জিয়া শহীদের সংখ্যা নিয়ে তার শংসয়ের কথা জানিয়েছিলেন।
সেদিন বিএনপি নেত্রী বলেন, ‘আজকে বলা হয়, এতো লক্ষ লোক শহীদ হয়েছেন। এটা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে যে আসলে কত লক্ষ লোক মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। নানা বই-কিতাবে নানারকম তথ্য আছে।’
এই বক্তব্যের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া কিছুদিন আগে বলেছিলেন, ৩০ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করেনি, এই সংখ্যা নাকি ঠিক না। এর থেকে লজ্জার আর কী হতে পারে? এর থেকে জঘন্য কথা মনে হয় আর কিছু হতে পারে না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পাকিস্তানিদের অপপ্রচার ও তার বক্তব্যের কোনো সূত্র আছে কি না আমি জানি না, তবে মনে হচ্ছে যেন একই সুরে তিনি কথা বলার চেষ্টা করছেন। এটা শহীদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা এবং শহীদদের প্রতি অবমাননা করা ছাড়া আর কিছু না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কখনই পৃথিবীর কোনো দেশে কত গণহত্যা হলো এটা কেউ দেখার চেষ্টা করে না। কিন্তু গণহত্যা যে হয়েছিল সেটার চিহ্ন তো সমগ্র বাংলাদেশেই আছে। বাংলাদেশের এমন কোনো পরিবার নেই, যাদের কেউ না কেউ জীবন দেয়নি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘যেভাবে গণহত্যা হয়েছিল, গ্রামের পর গ্রাম ছারখার করা হয়েছিল-সেটা প্রত্যেকেরই জানা। এ নিয়ে প্রশ্ন করা বাঙালি জাতির প্রতি চরম অবমাননা… লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, তার প্রতি অবমাননা ছাড়া তা আর কিছুই না।’
অনুষ্ঠানে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠার কাহিনিও জানান প্রধানমন্ত্রী। জানান, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কানাডা প্রবাসী কয়েকজন মানুষ ‘ভালোবাসি মাতৃভাষা’ নামে একটি কমিটি করেছিল। তারা জাতিসংঘে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে ঘোষণা করার জন্য আবেদন করেন। কিন্তু জাতিসংঘ সাধারণত কোনো সদস্য দেশের প্রস্তাব ছাড়া কিছু গ্রহণ করে না। এই বিষয়টা ওই কমিটির দুই সদস্য সালাম ও রফিক বাংলাদেশ সরকারকে জানান। এরপর সরকার ইউনেস্কোতে একই প্রস্তাব পাঠায়, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করে ২১ ফেব্রুয়ারির সব ঘটনা তুলে ধরে। আর ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর জাতীয় সম্মেলনে ভোটাভুটিতে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা রক্ষা করা ভাষার অধিকার আদায়ে লড়াই করা বাংলাদেশের দায়িত্ব বলেও মনে করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, এ জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট তৈরি করে গবেষণা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্মাননা প্রদান
এর আগে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখায় ১৭ বিশিষ্ট ব্যক্তিকে একুশে পদক তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী। এরা হলেন, ভাষা আন্দোলনের জন্য ভাষাসৈনিক অধ্যাপক শরিফা খাতুন, শিল্পকলায় (সংগীত) সুষমা দাস, জুলহাস উদ্দিন আহমেদ, ওস্তাদ আজিজুল ইসলাম ও রহমতউল্লাহ আল মাহমুদ সেলিম, শিল্পকলায় (চলচ্চিত্র) তানভীর মোকাম্মেল, শিল্পকলায় (ভাস্কর্য) সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ, শিল্পকলায় (নাটক) সারা যাকের, সাংবাদিকতায় আবুল মোমেন ও স্বদেশ রায়, গবেষণায় সৈয়দ আকরম হোসেন, শিক্ষায় অধ্যাপক ইমেরিটাস আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, সমাজসেবায় অধ্যাপক মাহমুদ হাসান, ভাষা ও সাহিত্যে (মরণোত্তর) কবি ওমর আলী ও সুকুমার বড়ুয়া এবং শিল্পকলায় (নৃত্য) শামীম আরা নীপা। পদক বিজয়ী প্রত্যেকে পেয়েছেন ১৮ ক্যারেট মানের ৩৫ গ্রাম সোনার একটি পদক এবং দুই লাখ টাকা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গুণীজনদের সম্মান করা, তাদের কদর করা জাতি হিসেবে আমাদের একান্ত জরুরি। কারণ, তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই আমাদের জাতির ভবিষ্যত গড়ে উঠবে।’