পর্দা মুসলিম নারীর সৌন্দর্য, নারীর মানসম্মান, ইজ্জত-আবরুর রক্ষাকবচ। ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত’ নারীকে মর্যাদাবান করেছে যে ইসলাম, নারীর মর্যাদাকে অক্ষুণ্ন রাখতে পর্দার গুরুত্বকে অনিবার্যও করেছে সেই ইসলাম। তাইতো নারীদের জন্য পর্দা পালন করা ফরজ ইবাদাত।
আবার পর্দা মুসলিম নারীদের সৌন্দর্য হলেও তা পালন করা পুরুষদের জন্যও ফরজ করা হয়েছে। এ কথা ভাবা ঠিক নয় যে, তা শুধু নারীদের জন্যই; বরং পুরুষের জন্যও পর্দা ফরজ। আর এ কারণেই আল্লাহ তাআলা পর্দার সম্পর্কে কঠোরভাবে নির্দেশ প্রদান করেছেন। পর্দার গুরুত্ব ও উপকারিতা তুলে ধরে আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘(হে নবি! আপনি) মুমিনদের বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নিচু করে এবং লজ্জাস্থানের হিফাজত করে, এটা তাদের জন্য অধিকতর পবিত্র। তারা যা কিছু করে আল্লাহ সে বিষয়ে অবগত এবং ঈমানদার নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নিচু রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান, তাছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত দাসি, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো কাছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। (সুরা নূর : আয়াত ৩১)
কুরআনুল কারিমের এ আয়াতে থেকে বোঝা যায়, পর্দা প্রথমত পুরুষদের জন্য ফরজ। অতপর নারীদের পর্দা পালনের কথা বলেছেন। কারণ পর্দা করার মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষকে চারিত্রিক অবক্ষয় থেকে রক্ষা করা।
কেনন আল্লাহ তাআলা নারীকে পুরুষের চোখে অত্যন্ত আকর্ষণীয় করে সৃষ্টি করেছেন। আবার পুরুষের আকর্ষণও নারীর মধ্যে তৈরি করে দিয়েছেন। সে কারণেই ইসলামি শরিয়তের হুকুম অমান্য করে বেপর্দা হওয়া নারী এবং পুরুষের জন্য কোনোভাবেই বৈধ নয়।
বিশেষ করে আল্লাহ তাআলা নারীদের নিরাপত্তায় পর্দার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে সুষ্পষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘হে নারীগণ! তোমরা তোমাদের ঘরের মধ্যে অবস্থান কর। পূর্ববর্তী অন্ধকার যুগের মতো সাজসজ্জা করে পরপুরুষের সম্মুখে বাহির হবে না। নামাজ আদায় কর, জাকাত দাও এবং আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য কর।’ (সুরা আহযাব : আয়াত ৩৩)
নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই পর্দা পালনের উপকারিতা রয়েছে। বিশেষ করে হাদিসে নারীদের জন্য পর্দা পালনে গুরুত্বপূর্ণ ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। পর্দা পালনকারী নারীরা আল্লাহর রহমত দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘নারী গোপনীয় সত্তা, তারা যদি প্রকাশ্যে (বেপর্দা হয়ে লোকালয়ে) বের হয় তবে শয়তান তাদের দিকে উঁকি দিয়ে তাকায়। আর যে নারী তার ঘরের মধ্যে অবস্থান করে (পর্দা পালন করে) সে আল্লাহর রহমতের অধিক নিকটবর্তী থাকে।’(তিরমিজি)
পুরুষ যেমন নারীর দিকে তাকাবে না, তেমনি নারীও আড়ালে থেকে পুরুষদের দিকে দৃষ্টিপাত করবে না। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ বিষয়টি হাদিসে সুন্দর ও সুস্পষ্ট সমাধান পেশ করেছেন।
হজরত উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন আমি ও মায়মুনা রাদিয়াল্লাহু আনহা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে ছিলাম। এমতাবস্থায় (দৃষ্টিহীন সাহাবী) হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে আগমন করলেন।
তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তোমরা পর্দার অন্তরালে চলে যাও।’ আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! ইনি কি দৃষ্টিহীন নন? ইনি তো আমাদেরকে দেখছেন না। জবাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা কি তাকে দেখছো না? (আবু দাউদ, মুসনাদে আহমাদ, তিরমিজি, মিশকাত)
অন্য বর্ণনায় এসেছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নারী গোপনযোগ্য। যখন সে ঘর থেকে বের হয় তখন শয়তান তার দিকে তাকাতে থাকে। (মিশকাত)
বতর্মান স্যাটেলাইট, ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি পর্যায়ে নারীদেরই পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ইন্টারনেটের এসব ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী এমনকি বয়স্ক ব্যক্তি নারী-পুরুষরাও, যা সমাজের জন্য এক ভয়ংকর মহামারি আকার ধারণ করছে।
এ কারণেই আজ থেকে দেড় হাজার বছর পূর্বে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ওহির মাধ্যমে পর্দার যে জ্ঞান লাভ করেছিলেন, তা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন। তাই কুরআন ও হাদিসের আলোকে যাদের সঙ্গে পর্দা করা ফরজ, তাদের সামনে বেপর্দা হয়ে খোলামেলা পোশাকে যাতায়াত করা বা অবাধে দেখা-সাক্ষাৎ করা হারাম এবং কবিরা গোনাহ।
কেউ কেউ পর্দার বিধানকে ধর্মীয় মনগড়া মতবাদ বলে আখ্যায়িত করা, মনে পর্দা বড় পর্দা; তাছাড়া পর্দা নিজের কাছে এমন কথা বলে পর্দার গুরুত্ব ও তাৎপর্যকে অস্বীকার করে। এমনটি ভাবা কুরআন ও হাদিসকে অস্বীকার করা ছাড়া বৈ আর কিছুই নয়। এ সব কথা শুধু পর্দার খেলাপ নয় বরং ইসলামে এ সব কথা-বার্তা বলাও মারাত্মক অপরাধ।
বেপর্দার সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো প্রতিটি পদে পদে নারীদের হয়রানির স্বীকার হওয়া। ইভটিজিংয়ের স্বীকার হওয়া। পথে-ঘাটে, স্কুল-কলেজে, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব জায়গায় ঘৃণ্য ও নোংরা আচরণের স্বীকার হওয়া এবং অশ্লীল বাক্যবানে জর্জরিত হওয়া।
বর্তমান সময়ে ফ্যাশনের নামে নারী ও পুরুষকে বেপর্দা করার যে হিড়িক শুরু হয়েছে, তা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অশান্তির এক মরণ ব্যাধি। মুসলিম উম্মাহর উচিত অশালীন পোশাক পরিহার করে, শালিন পোশাক পরিধান করা। সমাজের প্রত্যেক নারী ও পুরুষের উচিত তাদের নিজ নিজ আত্ম-সম্মানবোধ এবং সৌন্দর্যের হিফাজত করা।
পর্দার বিধান পালনের মাধ্যমে নারী ও পুরুষের সংযত জীবন-যাপন ব্যক্তি-পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে। তাইতো আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে সমগ্র মানবজাতিকে হুশিয়ার করে দিয়ে ঘোষণা করেছেন, ‘হে মানবজাতি! তোমরা এ শান্ত পৃথিবীর মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি কর না।’ সুতরাং পর্দার লংঘন করে চলাফেরা করা, দুনিয়ার কর্ম সম্পাদন করা নারী-পুরুষ কারো জন্যই শোভনীয় নয়।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে দুনিয়াতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় এবং নারী ও পুরুষদের আত্ম-সম্মানবোধ ও মর্যাদা রক্ষায় পর্দার পরিপূর্ণ বিধান পালন করে তাকওয়া অবলম্বন করার তাওফিক দান করুন। দুনিয়ায় সুন্দর জীবন এবং পরকালের চিরস্থায়ী সফলতা লাভে পর্দার বিধান সমাজের সর্বস্তরে বাস্তবায়নে প্রত্যেক মুসলিম নারী ও পুরুষদের কাজ করে যাওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।