দক্ষিণাঞ্চলে অর্ধশত প্রজাতির মাছ বিলীন প্রায়

দক্ষিণাঞ্চলে অর্ধশত প্রজাতির মাছ বিলীন প্রায়

দক্ষিণাঞ্চলে দেশীয় অর্ধশত প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব প্রায় বিলীন। এখন আর পুকুর ভরা মাছ নেই। “মাছে ভাতে বাঙালি”প্রবাদটিও এখন হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম। বিকল্প হিসেবে এসেছে শুটকি ও সামুদ্রিক মাছের আমদানি।

জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অসচেতনতা, অবাধে লবণ পানি তুলে বাগদা চিংড়ি চাষ, ফসলের ক্ষেতে দেশীয় অর্ধশত প্রজাতির ক্ষতিকর কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের যথেচ্ছা ব্যবহার এবং মিঠাপানির অভাবে মৎসখনি খ্যাত দক্ষিণাঞ্চলে অর্ধশত প্রজাতির মিঠাপানির দেশীয় মাছের অস্তিত্ব বিলীন হতে চলেছে। সুস্বাদু দেশীয় মাছ এখন আর তেমন মিলছে না।

বাজারে যদি বিদেশি ক্রস ও কার্প জাতীয় মাছ না থাকতো তাহলে আমিষের চাহিদা মিটানো সম্ভবপর ছিলো না। দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার শহর বন্দর গ্রামেগঞ্জে সর্বত্রই দেশীয় মাছের চরম সংকট। যা পাওয়া যায় তারও অগ্নিমূল্য। বিগত দিনে সরকারের উদাসীনতা, মৎস্য অধিদফতরের বাস্তবসম্মত সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণের অভাব এবং যে সকল প্রকল্প ও কর্মকাণ্ড হাতে নেয়া হয়েছিল তার যথাযত বাস্তবায়ন না করায় এ সেক্টরটি “শিকেয়” উঠেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

অতিব গুরুত্বপূর্ণ এবং অত্যাবাশকীয় সম্ভবনাময় এ খাতটি এখন চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মৎস্য অধিদফতর এবং কয়েকটি এনজিও এসব বিষয়ে কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তবে তাও যৎ সামান্য। তাছাড়া যে সকল প্রচলিত আইন ও ধারা রয়েছে তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। জনসচেতনতা তৈরিতে দায়িত্বশীলরা এগিয়ে আসছে না।

মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, কয়েক দশক পুর্বেও এ অঞ্চলে আড়াইশ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ ছিল। কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে এসব মাছের অনেক প্রজাতি এখন চোখে পড়ে না। তাছাড়া বর্ষা মৌসুমের সময় নদী-খাল-বিল থেকে কারেন্ট জালের মাধ্যমে ব্যাপকহারে ডিমওয়ালা মাছ ধরার কারণে দেশীয় মিঠা পানির বিভিন্ন প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কালের গর্ভে মাছে-ভাতে বাঙালির ঐতিহ্য আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।

মৎস অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, দুই দশক পূর্বেও পিরোজপুরের মঠবাড়ীয়া, নেছারাবাদ, নাজিরপুর, বাগেরহাটের, শরনখোলা, মোড়েলগঞ্জ, মংলার, রামপাল, খুলনার রূপসা, তেরখাদা, দিঘলিয়া, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া, পাইকগাছা, কয়রা ও ফুলতলাসহ উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় আড়াইশ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ পাওয়া যেত।

যার মধ্যে শোল, টাকি, কৈ, গজাল, টেংরা, চিতল, শিং, খয়রা, বাটা, পাইশ্যা, কালিবাউশ, বাইল্যা, কাজলি, সরপুটি, পাবদা, খৈলশা, ডগরি, জাবা, ভোলা, বাগাড়, বাশপাতা, ভাঙ্গান, কাইন, খল্লা, দেশি পুটি, গোদা চিংড়িসহ অর্ধশত প্রজাতির মিঠাপানির মাছ এখন বিলুপ্তির পথে। এ সকল মাছ স্বাদে ও পুষ্টিগুণে ছিল ভরপুর।

দেশের দূর দূরান্তের বাজার সমূহে দক্ষিণাঞ্চলের সুন্দরবন অঞ্চলের পূর্ব বন বিভাগের শরনখোলা, মোড়েলগঞ্জ, মংলার, রামপাল,  সুন্দরবনের পশ্চিম বিভাগের সাতক্ষীরার শ্যামনগর খুলনা কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ উপজেলার কালা বগী, নলিয়ান থেকে বিপুল পরিমাণ দেশীয় অর্ধশত প্রজাতির-মাছ সরবরাহ করা হতো। কিন্তু এখন দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলায় চট্রগ্রাম কক্সবাজার থেকে মাছ এনে চাহিদা পূরণ করা হয়।

পরিবেশ ও মৎস বিজ্ঞানীদের মতে, দক্ষিণাঞ্চলে মৎস প্রজাতি বিলুপ্তির কারণ হচ্ছে অপরিকল্পিততভাবে জলাধারে বাধ দেয়ায় ভরা বর্ষা মৌসুমে ডিম ছাড়তে মা মাছ আসতে বাধা পায়। মাছের স্বাভাবিক চলাচলে বাধা তদুপরি খাল, বিল, হাওড়, বাওড়গুলো ক্রমান্বয়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় প্রতিনিয়ত মাছের প্রজনন ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে আসার কারণে মাছের বংশ বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।

তাছাড়া বিভিন্ন কারণে পানি দুষণ জলাশয়ের গভীরতা হ্রাস, ছোট মাছ ধরার জন্য কারেন্ট জালের ব্যবহারের কারণেও মাছ ধ্বংস হচ্ছে। মারাত্মক পানি দূষণের কারণে আজ খুলনার ময়ূর নদী মাছের বংশ বৃদ্ধি ও জীবন ধারনের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে।

পিরোজপুর সদর ও মোড়েলগঞ্জ কয়েকজন প্রবীন ব্যাক্তি জানিয়েছেন, এক সময় জেলার বিভিন্ন নদীতে ২ কেজি ওজনের ইলিশ মাছ পাওয়া যেত। নদীতে পাওয়া যেত ৫ থেকে ৬ কেজি ওজনের বোয়াল ও আইড় মাছ। এমন কোনো মাছ ছিল না যা এ অঞ্চলের বিলে পাওয়া যেত না। নলামারা বিলে ১২ কেজি ওজনের কালিবাউশ মাছও তারা জাল দিয়ে ধরেছেন।

কিন্তু এখন এগুলো নতুন প্রজন্মের কাছে কল্প কাহিনী। দেশীয় প্রজাতির মাছ সংরক্ষণে মৎস্যজীবী তথা সর্বসাধারণকে সচেতন করে তোলার পাশাপাশি স্থানীয় মৎস্য অধিদফতরের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ ও মৎস্য সংরক্ষণ আইনের সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করণের মাধ্যমেই সম্ভব।

জেলা সংবাদ