বীর প্রতীকের কবর আগাছায় ঢাকা, হয়নি স্মৃতিফলক

বীর প্রতীকের কবর আগাছায় ঢাকা, হয়নি স্মৃতিফলক

বাঙালির মহান বিজয় ৪৫ বছর পেরিয়ে কিছুদিন আগে ৪৬ বছরে পদার্পণ করেছে। গড়েছে কীর্তিময় বহু ইতিহাস। সৃষ্টি হয়েছে নতুন নতুন অধ্যায়। আজ বাঙালিরা চষে বেড়াচ্ছেন বিশ্বজুড়ে। কিন্তু অতীত বড়ই নিষ্ঠুর, ১৯৭১ সাল, মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি নিধন, লাখো বোনের ইজ্জত হনন, তাজা প্রাণের রক্ত এ সবই আমাদের আজকের বর্তমান আনতে গিয়ে।

কিন্তু যা ফেলে আসা তার সব অতীত। পেছনে তাকানোর কি সুযোগ আছে? কোথায় শহীদের কবর, কে নেবে তার খোঁজ? অবহেলা আর অযত্নে মুছে যাচ্ছে সব শহীদের কবরের চিহ্ন। আগামী প্রজন্ম হয়তো এই স্থানে ঘর-বাড়ি করবে না হয় হাট-বাজার।

লাখো শহীদের কথা বাদ, যারা দেশের জন্য বীরোচিত যুদ্ধ করে রাষ্ট্রীয় খেতাব পেয়েছেন, তাদের খোঁজ কি কেউ জানে? তাদের সংখ্যা ৬৭৭ জন, তার মধ্যে বীরশ্রেষ্ঠ ৭ জন, বীর উত্তম ৬৯ জন, বীর বিক্রম ১৭৫ জন এবং বীর প্রতীক ৪২৬ জন। এদের মধ্যে একজন চুয়াডাঙ্গার কৃতি-সন্তান বীর প্রতীক হারুন-অর-রশিদ।

প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা দেশ মাতৃকাকে স্বাধীন করার জন্য জীবন সমর্পণ করে যুদ্ধ করেছেন। তাদের মধ্যে কারও কারও সমর্পণ ইতিহাসের অনেক ঘটনাকে হার মানিয়েছেন। সরকার তাদের সেই সমর্পণকে স্বরণীয় করে রাখতে, সম্মান জানাতে খেতাব দিয়েছেন। কিন্তু আজ অবহেলায় তাদের স্মৃতি ও আত্মত্যাগ হারিয়ে যেতে বসেছে।

তেমনি একজন অবহেলিত, পরিচয়হীন চুয়াডাঙ্গার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হারুন-অর-রশিদ (বীর প্রতীক)। দুঃখের বিষয় হলো তিনি একজন রাষ্ট্রীয় খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা তা এলাকার মুক্তিযোদ্ধারাও অবগত নয়। তার কবর বেগমপুর ইউনিয়নের সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আয়ুব আলী ও গুটি কয়েকজন ছাড়া কেউ চেনেন না।

বাঁশ বাগানে তার কবরটি আগাছা আর বুনো জঙ্গলে ঢেকে গেছে। ২০১০ সালে মাটি দিয়ে অন্য কবর থেকে সামান্য উচু করে দেন স্থানীয় কিছু স্বাধীনতা সচেতন মানুষ, কিন্তু প্রতি বর্ষায় পানিতে সমান হয়ে যায়। যে পুরাতন গাছ দেখে কবরস্থান নির্ণয় করা হতো সেটিও কিছুদিন আগে কাটা হয়েছে।

১৯৪৮ সালে চুয়াডাঙ্গার সদর উপজেলার বেগমপুর ইউনিয়নের রাংগিয়ারপোতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হারুন-অর-রশিদ (বীর প্রতীক)। তার বাবার নাম আমদ আলী মণ্ডল ও মা`র নাম বিরাজ খাতুন।

হারুন-অর-রশিদ সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মাত্র ২৩ বছর বয়সে যুদ্ধে যান এবং এসময় তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি তার বাবার ব্যবসায় সহযোগিতা করতেন।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক রূপ পেলে তিনি ৮ নম্বর সেক্টরের চুয়াডাঙ্গা সাব-সেক্টরের অধিনায়ক নিযুক্ত হন। তার নেতৃত্বে বা পরিচালনায় অনেক যুদ্ধ সংঘটিত হয়, এর মধ্যে যদুপুর ক্যাম্প আক্রমণ অন্যতম।

১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশের ভেতরে প্রাথমিক অবস্থান থেকে হারুনুর রশীদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা রওনা হয়েছিলেন লক্ষ্যস্থলে। ২৭ নভেম্বর হারুনুর রশীদ যদুপুর ক্যাম্পে তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে আক্রমণ চালান। সহযোদ্ধারাও সংকেতের অপেক্ষা না করে গুলি শুরু করেন। ফলে হারুনুর রশীদ ও তার সঙ্গে থাকা সহযোদ্ধা ক্রসফায়ারের মধ্যে পড়ে যান।

অনেক কষ্টে তারা ক্যাম্পের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। পরে তার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালান। ওই দিনে হারুনুর রশীদ এর গোলার বারুদে ৪ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়।

কিন্তু একটি বুলেট বিদ্ধ হয় হারুন-অর-রশিদের শরীরে, মুক্তিপাগল হারুনের তখনও শ্বাস কিছুটা চলছিল। সহযোদ্ধারা হারুনকে নিয়ে পিছু হটলেন। তার পরের দিন বাদ জোহর তাকে চুয়াডাঙ্গা সদরের বেগমপুর ইউনিয়নের যদুপুর গ্রামের কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগে স্বাধীন এই দেশ। আমাদের বাংলাদেশ। এখনো সব শহীদদের নাম আমরা জানি না, ঠিকানা জানা নেই, নামের তালিকা নেই, অনেকের তালিকা আছে, বীরত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ খেতাব আছে কিন্তু পরিচয় নেই, তাদের স্মৃতি রক্ষার ব্যবস্থা নেই।

দেশের জন্য যিনি জীবন উৎসর্গ করলেন, স্বাধীনতার এতো বছর পরে এসেও তার কবর এখন বাশ বাগানে অচিহ্নিত ও অবহেলিত। তার স্ত্রী মারা গেছে ২০০৪ সালে, তাই এখন খোঁজ নেওয়ারও কেউ নেই।

এসব কবর সরকারিভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। না হলে একসময় নতুন প্রজন্মের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের সম্পর্কে কোনো ধারণা থাকবে না।

জেলা সংবাদ