সত্যিই জীবন কত অদ্ভুত! বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার জীবন কাহিনি ও পলাশির করুণ পরিণতি নিয়ে দেশ বরেণ্য চলচ্চিত্রকার প্রয়াত খান আতা যে চলচ্চিত্র নির্মান করেছিলেন, তাতে একটি জীবনধর্মী সঙ্গীত ব্যবহৃত হয়েছে। যার প্রথম দুই চরণ হলো ‘নদীর এ কূল ভাঙে এ কূল গড়ে এই তো নদীর খেলা, সকালে আমিররে ভাই ফকির সন্ধ্যে বেলা।’
সত্যিই জীবনটা এমন উত্থান-পতনের খোলা মঞ্চ। ক্রিকেটারদের জীবনটাও ঠিক তেমন। আজ হিরো তো কাল খলনায়ক। আজ পাদ প্রদীপের আলোয়। কাল অন্তরালে। মাত্র ২৪ ঘন্টা সময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলেও এমন ওঠা নামার পালা। বুধবার দুপুরের সঙ্গে আজকের দুপুরের কি বিস্তর ফারাক! আসুন একটু জেনে নেই কি সেই পার্থক্য।
দৃশ্যপট ১. ১৮ জানুয়ারী সকাল। ঘড়ির কাটা দুপুর একটা স্পর্শ করেনি। ক্রাইস্টচার্চের হ্যাগলি ওভালের ঠিক মাঝখানে মানে পিচের আশপাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন দু`জন মানুষ। দুজনারই পরনে বাংলাদেশ জাতীয় দলের ট্র্যাক স্যুট। একজন কোচ চন্দিকা হাথুরুসিংহে। আরেকজন মুশফিকুর রহীম। তারা মিনিট পাঁচ সাতেক পিচের আশপাশে দাঁড়িয়ে যে উইকেটে খেলা হবে, তা দেখে (যদিও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির কারণে পিচের অর্ধেকেরও বেশি অংশ ঢাকাই ছিল) কথা বলতে বলতে ড্রেসিং রুমে আসলেন।
বাংলাদেশ ও নিউজিল্যান্ডের চলতি সিরিজ কভার করতে যে সব সাংবাদিক এখন ক্রাইস্টচার্চে তাদের বড় অংশ, ঐ দৃশ্য অবলোকন করলেন। তখন কানাঘুষা শুরু হয়ে গেলো। মুশফিকুর রহীম তো ক্রিকেট অন্তঃপ্রাণ। হয়তোবা ওয়েলিংটন হাসপাতালের চিকিৎকসদের প্রটোকল পরামর্শ সত্বেও ঠিক টেস্টে মাঠে নেমে পড়বেন। তাই বুঝি উইকেট দেখে কোচের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আসলেন সাজঘরে।
টিম বাংলাদেশে সবচেয়ে সিরিয়াস ক্রিকেটারের নাম মুশফিক। অনুশীলনে তার আগে কেউ আসতে পারে না। আবার সবার প্র্যাকটিস শেষ হয়ে যাবার পরও নিজের গরজে বাড়তি প্র্যাকটিসটাও মুশফিকই করেন বেশি। তাই বলাবলি হল, মুশফিক যেমন সিরিয়াস ক্রিকেটার। ইনজুরি তাকে গ্রাস করতে নাও পারে। হয়তো খেলেও ফেলতে পারেন টাইগার টেস্ট অধিনায়ক। মুশফিক বলেই এ কথাটা কম বেশি সবার মনেই গেঁথে গেল। সবাই বলা বলি করলেন, মুশফিক যেহেতু, তাই খেলেও ফেলতে পারেন।
কিন্তু আজ দুপুর পৌনে একটার দিকে ঠিক তার বিপরিত দৃশ্য দেখেই ভুল ভাঙলো সবার। বাংলাদেশের প্র্যাকটিস ছিল দুপুর ১২ টা ৪০ মিনিটে। ঠিক পৌনে একটার কয়েক মিনিট পর হ্যাগলে ওভালে ঢুকলো বাংলাদেশের টিম বাস। বাস থেকে নেমে সিড়ি বেঁয়ে হ্যাগলো ওভালের ড্রেসিং রুমে ওঠার আগে ঠিক কালকের মত দু`জন মানুষ সোজা মাঠের মাঝখানে পিচ যেখানে, ঠিক সেখানে চলে গেলেন। পিচ দেখে পাঁচ থেকে সাত মিানট কথাও বললেন। তারপরও কথা বলতে বলতে সাজঘরের পথে পা বাড়ালেন।
সময়কালের পার্থক্য মোটে ২৪ ঘন্টা। দৃশ্যপট এক। কিন্তু পিচের মাঝখানে কথা বলা দুই চরিত্রের রদ বদল। একজন হাথুরুসিংহে। অন্যজন তামিম ইকবাল। টেস্ট শুরুর ঠিক ২৪ ঘন্টা আগে যখন কোচ তামিম ইকবালকে নিয়ে পিচ দেখতে গেছেন। এবং তার সঙ্গে একান্তে কথা বলতে বলতেই সাজঘরে। ঠিক তখনই বোঝা গেল , মুশফিক আর দৃশ্যপটে নেই। ইনজুরি তাকে আবারো গ্রাস করেছে। কাল থেকে যে টেস্ট শুরু, তার অধিনায়ক আর মুশফিক নন। তামিম ইকবাল।
কোচ হাথুরুসিংহে সোজা সিড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলেন। আর তামিম আসলেন অপেক্ষমান সাংবাদিকদের সামনে। মিডিয়া ম্যানেজার রাবিদ ইমামকে বললেন, ‘রাবিদ ভাই প্রেস কনফারেন্সের প্রস্তুত নিন। তখনই জানা হয়ে গেলো, বোঝাও হলো, শুক্রবার থেকে যে দ্বিতীয় টেস্ট শুরু হবে, তাতে বালাদেশের অধিনায়ক তামিম ইকবাল।
সেই ওয়ানডে সিরিজ দিয়ে শুরু। প্রায় ম্যাচেই একটা দৃশ্য চোখে পড়ছে। সুযোগ তৈরি হচ্ছে। সম্ভাবনার দরজাও খুলছে। সে পথে হেঁটে খানিকটা পথ এগিয়েও যাচ্ছে। তারপর একটা পর্যায়ে গিয়ে কেমন যেনসব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কাজের কাজটি হচ্ছে না। এই না হবার পালা চলছেই।
দেখতে দেখতে সফর শেষ হবার সময়ও যে ঘনিয়ে এলো। এইতো ২৪ ঘন্টা পর শুরু দ্বিতীয় ও শেষ টেস্ট। এ ম্যাচের আগে ইনজুরি ঘিরে ধরেছে চারদিক থেকে। নিয়মিত অধিনায়ক মুশফিকু রহীম ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলে ব্যথার কারণে বাইরে। ওপেনার ইমরুল কায়েসও ঊরুর ব্যথায় সাইড বেঞ্চে।
পড়ন্ত বিকেলের খবর, মুমিনুল হকও একাদশের বাইরে ছিটকে পড়েছেন। এমনিতেই সাফল্য ধরা দিচ্ছেন। ‘সোনার হরিণ’ হয়ে পড়েছে। তার সাথে আবার ইনজুরির ভয়াল থাবা। জয় ধরা না দিলেও ওয়েলিংটন টেস্ট শুরুর আগেও টিমের যে আত্ববিশ্বাস ছিল, ক্রিকেটাররা যতটা চাঙ্গা-উৎফুল্ল ছিলেন, তাতে ভাটা এসেছে। একটা গুমোট ভাব চলে এসেছে। এরকম একটা ভাঙা চোরা দলের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক তামিম ইকবাল।
তিনজন অপরিহার্য্য পারফরমার নেই। মুশফিক নেই, যিনি একাধারে ‘ থ্রি ইন ওয়ান। ’ কীপার। অধিনায়ক এবং মিডল অর্ডারের অন্যতম স্তম্ভও। তার পাশাপাশি নেই ওপেনার ইমরুল কায়েসও। এমনিতেই সাফল্য ধরা দিচ্ছে না। সম্ভাবনার দরজা খুলছে শুধু। কিন্তু সাফল্যের মঞ্চে আর ওঠা সম্ভব হচ্ছে না। তার সঙ্গে এক ঝাঁক নিয়মিত ও অপরিহার্য পারফরমার ছাড়া খেলতে হবে।
এ দায়িত্ব প্রাপ্তি কতটা সুখের? নাকি বাড়তি চিন্তা-টেনসন ও চাপের? তামিম কি চাপে? প্রশ্ন উঠলো। প্রেস কনফারেন্সে এ সাংবাদিরকর প্রশ্ন ‘আপনি কি চাপে? মানসিকভাবে ঠিক আছেন? তামিমের চিবুক সোজা করা জবাব, ‘না না মোটেই চাপে নেই। আমাকে যখন সহ অধিনায়ক করা হয়েছে, তখন থেকেই একটা মানসিক প্রস্তুতি থাকে। আমি জানি, বুঝি কোন কারণে এক ছোট সময়ের জন্য হলেও অধিনায়কের অনুপস্থিতিতে নেতৃত্ব দিতে হবে। তাই মানসিক প্রস্তুুতি সব সময়ই থাকে। কাজেই বাড়তি চাপ অনুভব বা বোধ করা কিছুই নেই।’
কথা বলার সময় তার মুখ ও শরীরী ভাষা বলে দিচ্ছিল, তিনি মনের দিক থেকে খানিকটা প্রস্তুতও ছিলেন। তাইতো চটপট ব্যাখ্যা, ‘আমার দায়িত্ব দুটা। এক ব্যাটিংটা ঠিক মত করা। দলকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখা। আর এখন মাঠে দল পরিচালনা। কাজেই বাড়তি চাপের কিছু নেই। আমি মনের দিক থেকে তৈরি। জানি কাজটা সহজ হবে না। চ্যালেঞ্জিং হবে। কয়েকজন অতি নির্ভরশীল পারফরমার নেই। কিন্তু কিছু করার নেই। ইনজুরির ওপর কারো হাতও নেই। আমার চেষ্টা থাকবে , দলকে যতটা সম্ভব চাঙ্গা রাখা। এবং মাঠে সামর্থের সেরাটা উপহার দেয়ায় অনুপ্রাণিত করা।