এবার দেশব্যাপী আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষক যখন খেত থেকে আলু তুলছেন তখন ফলন দেখে খুব খুশি হচ্ছেন। কিন্তু বিপত্তিটা ঘটছে তখন, যখন কৃষক আলু বাজারে তুলছেন। ব্যাপারীরা ফিরেও তাকাচ্ছে না। দু’একবার তাকালেও যে দাম বলছে তাতে কৃষক হতাশ। অথচ এ রকম হওয়ার কথা নয়। কারণ খুচরা বাজারে আলুর দাম কম নয়।
বগুড়ার মহাস্থানগড় ও মোকামতলা পাইকারি বাজারসহ বিভিন্ন বাজারে আলু বিক্রি হচ্ছে ৮ থেকে ১০ টাকা কেজি। অথচ বগুড়া ও আশপাশ শহরে খুচরা আলু বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকা কেজিতে। আলু চাষিরা বলছেন, ফড়িয়ারা সিন্ডিকেট করে দাম কম বলছে। বগুড়ার কয়েকজন কৃষক দুঃখ করে বলেন, ফসল ফলাই আমরা আর আমাদের ফসল বিক্রি করে লাভবান হয় ফড়িয়া ও মধ্যস্বত্বভোগীরা।
ঢাকার বিভিন্ন বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন জাতের আলু বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ৩০ টাকা কেজি দরে। নতুন আলু ২০ টাকা, পুরান ২৫ ও বগুড়ার লাল আলু বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা কেজি দরে। বগুড়ার কৃষকদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, শহরে খুচরা বাজারে যে দামে আলু বিক্রি হচ্ছে সে দামের সঙ্গে তুলনা করে দাম পেলেও আমরা পোষাতে পারতাম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কৃষকরা ঘরে আলু রাখছেন না। সামনে ইরি ধানের মৌসুম। ধান চাষ করতে টাকার প্রয়োজন। ধান লাগানোর আগেই জমিতে সার, পানি, চাষ ও চারাসহ বিভিন্ন উপকরণ প্রয়োজন হয়। এসব উপকরণের জোগান দিতে সব কৃষকই আলু বাজারে নিয়ে আসছেন। কারণ কৃষকের ঘরে এখন বিক্রিযোগ্য পণ্য একটাই তা হলো আলু। সব কৃষক একযোগে আলু বাজারে নেয়ায় ফড়িয়ারাও সুযোগ নিচ্ছে। এতে কৃষক অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার আলু চাষী রইস মণ্ডল জাগো নিউজকে জানান, বদলগাছী উপজেলা কৃষিনির্ভর। প্রতিটি কৃষকই কমবেশি আলু চাষ করেন। অধিকাংশ কৃষক উৎপাদিত আলু বিক্রি করে সংসারের চাহিদা মেটান। সামনে ধান চাষের সময়। অধিকাংশ কৃষকের টাকার প্রয়োজন। এজন্য সবাই একযোগে আলু বাজারে নিচ্ছেন।
কথা হয় খুলনার আড়তদার হাজি জবেদ আলী মোড়লের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, রংপুরের উৎপাদিত গ্যানেলা জাতের আলু প্রতি কেজি ৬ থেকে ৭ এবং ডায়মন্ড জাতের আলু প্রতি কেজি ১০ থেকে ১২ টাকা পাইকারি দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি সপ্তাহে দাম কমছে। প্রতিদিন গড়ে ৩০ ট্রাক ৬০০ মেট্রিক টন আলু নিয়ে খুলনার মোকামগুলোতে আসছে।
bograalu
মুন্সীগঞ্জে খবর নিয়ে জানা গেছে, সেখানে বর্তমানে আলু পাইকারি বাজারে ১২ টাকা আর খুচরা বিক্রি হচ্ছে ১৮ থেকে ২০ টাকায়। তবে প্রতিদিনই আলুর দাম কমছে। এখানকার আলু চাষি জাকির মিয়া জানান, এবার তিনি ২০ একর জমিতে আলু চাষ করেছেন, খরচও বেশি পড়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো পাইকার আলু কেনার জন্য আসছেন না। আরেক কৃষক মজনু জানান, আলু পাইকারদের মধ্যে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তারা জমিতে গিয়ে কৃষকের সঙ্গে দর-দাম সম্পর্কে কথা বলছে। বিক্রি করতে রাজি হলেও তারা সঠিকভাবে কিছু বলছেন না। আবার অন্য লোক পাঠিয়ে কম দাম বলে যায়।
নীলফামারী জেলার ফজলু মিয়া চার বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছেন। উৎপাদন খরচ হয়েছে ৮০ হাজার টাকা। বর্তমান বাজারদরে তার চার বিঘা জমির আলু বিক্রি হবে ৫০ হাজার টাকার মতো। ফজলু মিয়ার মতো এলাকার আরও দুই শতাধিক চাষি এভাবে আলু চাষ করে লোকসানের ঘানি টানছেন।
শরীয়তপুর সদর উপজেলার চরলঙ্ক্ষী নারায়ণের আদর্শ কৃষক মৌলভী আবদুল হামিদ বলেন, জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে আলু চাষ বেড়েই চলছে। তিনি বলেন, স্থানীয়ভাবে আমরা আলু সংরক্ষণ করতে পারি না। পাশের জেলার হিমাগারে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা অতিরিক্ত খরচ বহন করে আলু রাখতে হয়। এজন্য আমরা আলু চাষ করে লাভের মুখ দেখতে পাই না।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কবির হোসেন বলেন, মাটি ও জলবায়ু অনুকূলে থাকায় প্রতি বছরই এ অঞ্চলে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে। এ বছর অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে লক্ষ্যমাত্রার বেশি আলুর আবাদ ও বাম্পার ফলন হয়েছে। আলু চাষিদের লাভের মুখ দেখাতে জরুরিভিত্তিতে শরীয়তপুরে একাধিক হিমাগার স্থাপন করা দরকার।
কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরের আলু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হোসেনপুর থেকে ঢাকা পর্যন্ত আগে ট্রাক ভাড়া ছিল ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা, এখন বেড়ে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা হয়েছে। একইভাবে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আলু পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় গতবারের তুলনায় এ বছর হোসেনপুরের বিভিন্ন মোকাম থেকে আলু নিতে পাইকাররা আগ্রহী হচ্ছেন না। তাই আলুর দাম ক্রমশ কমে যাচ্ছে। লাভের আশায় আলু চাষ করে মোটা অঙ্কের লোকসানে পড়েছেন কৃষক।