ঘুষ দাবি ও নির্যাতনের অভিযোগে নরসিংদীর রায়পুরা থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ও দুই এসআইয়ের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের হয়েছে। সোমবার বিকেলে নরসিংদী জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ভুক্তভোগী মো. বশির উদ্দিন মামলাটি করেন।
মামলার আসামিরা হলেন- রায়পুরা থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজহারুল ইসলাম সরকার এবং উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোজাম্মেল হক ও মজিবুর রহমান।
আদালত মামলাটি তদন্ত করতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলার আরজি থেকে জানা গেছে, রায়পুরা উপজেলার বাঙ্গালীনগর গ্রামের হাফেজ মোহাম্মদ আলীর তিন ছেলে মো. নাসির উদ্দিন, মো. জামাল উদ্দিন ও মো. রিয়াজ উদ্দিন মালয়েশিয়ায় ‘আল-ফাটেক মিনি মার্কেট’সহ কয়েকটি স্থানে ব্যবসা করে আসছেন। তাদের দোকানের কর্মচারী রায়পুরা উপজেলার ফারুক, জাহিদ ও কবির সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে চার লাখ ৬০ হাজার রিংগিট (এক কোটি ১৫ লাখ টাকা) চুরি করেন।
পরে মালিকপক্ষ চুরির বিষয়ে ওই তিনজনকে ধরলে তারা টাকা নিয়েছেন বলে স্বীকার করেন। চুরির টাকা ফেরত দেয়ার বিষয়েও মালিকের সঙ্গে সমঝোতা করেন ওই তিনজন। পরে দোকান মালিকের বড় ভাই বশির উদ্দিনের কাছে চুরি করা অর্থ ফেরত দিতে তাদের অভিভাবকদের বলেন তারা।
তিনজনের টাকা চুরির ওই স্বীকারোক্তিটি সাংবাদিকরা ভিডিও ধারণ করেন। পরে তা মালয়েশিয়ার বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এরপর অভিযুক্ত কবির মালিকপক্ষকে টাকা দিতে চাইলেই সেখান থেকে অন্যত্র পালিয়ে যান ফারুক ও জাহিদ। পরে দোকান মালিক নাসির উদ্দিন পালিয়ে যাওয়া ওই দুই ব্যক্তির নামে মালয়েশিয়ার থানায় একটি মামলা করেন। সেখানে মামলা হওয়ার পর বশির উদ্দিনের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া ফারুকের বড় ভাই আবুল হাশিম দেখা করে চুরির ঘটনাটি মীমাংসা করার কথা বলেন।
২০১৫ সালের ২ জুলাই রায়পুরার মরজাল এলাকায় এসবি কোম্পানির অফিসে সাক্ষাৎ করেন বশির ও হাশিম। কিন্তু সেখানে বশিরকে টাকা না দিয়ে উল্টো হুমকি দেন হাশিম। একপর্যায়ে স্থানীয় সন্ত্রাসীদের দিয়ে বশিরকে জিম্মি করার চেষ্টা করেন। পরে তিনি বিষয়টি বুঝতে পেরে রায়পুরা থানার ওসি আজহারুল ইসলামকে ঘটনাটি জানান।
খবর পেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই থানার এসআই মজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পুলিশ পাঠান ওসি। রাত ১২টার দিকে বশির ও হাশিমকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। ওই রাতেই বশিরকে নিজের কক্ষে ডেকে নেন ওসি। সেখানে তিনি বশিরকে পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ দিতে বলেন। টাকা পেলে হাশিমের নামে মামলা দিয়ে চুরির টাকা ফেরত নিয়ে দেয়ারও আশ্বাস দেন ওসি।
সেখান থেকেই বশির বিষয়টি মালয়েশিয়ায় তার ছোট ভাই নাসির উদ্দিনকে জানান। তিনি বড় ভাইকে থানায় মামলা না করার পরামর্শ দেন।
থানায় মামলা না করার বিষয়টি বশির ওসিকে জানালে তিনি ক্ষিপ্ত হন। পরে তাকে থানায় অপেক্ষা করতে বলে ওসি হাশিমকে নিজের কক্ষে ডেকে নেন। পরে হাশিমের কাছ থেকে ওসি ১০ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করলে তিনি পাঁচ লাখ টাকা দিতে রাজি হন। ওই রাতেই তিনি ওসিকে দুই লাখ টাকা দিয়ে বাকি টাকা পরে পরিশোধ করতে চান।
বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গেই জানতে পারেন বশির। তাই রাতে থানা থেকে তিনি বেরিয়ে যেতে চাইলে ওসি ও এসআই মোজাম্মেল তাকে মারধর করেন। বশির বিষয়টি মুঠোফোনে নরসিংদীর এএসপি সার্কেলকে জানালে এসআই মোজাম্মেল ফোনটি কেড়ে নেন। পরদিন সকালে থানার পাশের বাসিন্দা অ্যাডভোকেট চন্দনকে ডেকে নিয়ে তিনজন মিলে আলোচনা করে তার নামে মিথ্যা মামলা লেখেন।
এরপর হাশিমকে বাদী করে বশির ও তার মালয়েশিয়া প্রবাসী তিন ভাইয়ের নামে মামলা করা হয়। ওই মামলায় বশিরকে আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠানো হয়। ছয়দিন জেলে থাকার পর বশির জামিনে ছাড়া পান।
এরপর ২০১৫ সালের ৮ মার্চ বশির উদ্দিন রায়পুরা থানার ওসি, এসআই মোজাম্মেল ও এসআই মজিবুরের বিরুদ্ধে নরসিংদীর পুলিশ সুপার ও পরে অতিরিক্ত উপ-মহা-পরিদর্শকের (ডিসিপ্লিন) বিভাগে লিখিত অভিযোগ করেন।
অভিযোগের পর ডিসিপ্লিন বিভাগের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. আবদুস সালাম সরেজমিনে ঘটনা তদন্ত করেন। পরে ১১ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন জমা দেন তিনি। ওই প্রতিবেদনে ওসি আজহার, এসআই মোজাম্মেল ও এসআই মজিবুরের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা উঠে আসে। এ ছাড়া তদন্ত প্রতিবেদনে ওসি আজহারসহ তিন পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারেরও অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু এরপরও দোষী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
এ কারণে বশির সেমবার বিকেলে নরসিংদী জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ওসি আজহারসহ তিন পুলিশ কর্মকর্তার নামে মামলা করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রায়পুরা থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজহারুল ইসলাম সরকার বলেন, আমি ওই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নই। মরজাল এলাকা থেকে স্থানীয়রা বশিরকে থানায় নিয়ে এলে মামলা নিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে।