‘বাহে হামরা এবার আলু চাষ করছি কিন্তু দাম নাই বলে খরচের টাকা তোলা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। এতে করি আলু নিয়া বিপাকত পড়েছি। আলু পচে যাবার ভয়ে অনেকে বিক্রির পাশাপাশি গো-খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করছে।’ কথাগুলো বলছিলেন রাজারহাট উপজেলার সিঙ্গেরডাবরীহাট এলাকার চাষি নজরুল ইসলাম।
চলতি মৌসুমে এবারে কুড়িগ্রামে বাম্পার আলুর ফলন হয়েছে। কিন্তু দাম কম হওয়ায় হতাশ আলু চাষিরা। অনেক আশা নিয়ে চাষিরা আলু চাষ করায় এবারে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আবাদ হয়েছে। আলুর ফলন বাম্পার হলেও বাজারে দাম নেই। ফলে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন চাষিরা।
এখানকার মাটি আলু চাষের উপযোগী। কৃষকদের আগ্রহ বাড়ছে এ ফসলের দিকে। এবারে নতুন জাতের আলুর ফলন ভালো হয়েছে। কৃষি বিভাগের নিয়মিত দেখাশুনা আর পরামর্শ কৃষকদের সহায়তা করেছে। দরিদ্রপীড়িত এ অঞ্চলে কাজের উৎস খুবই কম। ফলে প্রায় সবাই কৃষির উপর নির্ভরশীল।
জেলার ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্রসহ ১৬টি নদ-নদীর তীরবর্তী চরে আগাম জাতের আলু চাষ করে দাম না পাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন অনেক আলু চাষি। গেল বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চরাঞ্চলে আগাম জাতের আলু চাষ করেন। বাম্পার ফলন হলেও দাম না পাওয়ায় অনেক আলু চাষি দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। অনেকে ধার-দেনা করে আলু চাষ করায় টাকা পরিশোধ করতে কম দামে আলু বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে আলুর স্তূপ পড়ে আছে। আলু কেনার ক্রেতা নেই বললেই চলে। বাজারে আলু খুচরা বিক্রয় হচ্ছে প্রতি কেজি ১০ থেকে ১৪ টাকা দরে।
বাজারে নতুন আলু ওঠার পরে শুরুতে ৩০ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও দিন দিন বাজার দর নিম্নমুখী হতে থাকে। গত এক সপ্তাহ ধরে ১০ থেকে ১২টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে আলু। পাইকারি জমির খেত থেকে প্রতি বস্তা আলু বিক্রয় হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫৫০ টাকা পর্যন্ত।
রাজারহাট বাজারে তমিজ ব্যাপারী বলেন, প্রায় তিন একর জমিতে আলু চাষ করছি। আলু চাষে খরচ গেছে প্রায় সোয়া লাখ টাকা। ফলন মোটামুটি ভালোই হয়েছে। প্রতি বস্তায় ৮৫ কেজি ওজনে ৩২০ বস্তা আলু পেয়েছি। এর মধ্যে ৫০হাজার টাকার আলু বিক্রি করেছি। দাম না থাকায় বাকি বস্তা বিক্রি করতে পারিনি।
নাগেশ্বরী উপজেলার নুন-খাওয়া চরের আফজাল উদ্দিন বলেন, প্রতি বছর এই জেলার আলু রাশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্য দেশে যেত। ফলে আলু চাষিরা তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হতো না। কিন্তু গত বছর ভাইরাসজনিত কারণে আলু দেশের বাইরে না যাওয়ায় অনেক লোকসানের মুখ দেখতে হয়েছে অনেককেই। সরকার যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নেয় তাহলে আলু চাষিরা পথে বসে যাবে।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, জেলায় আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল পাঁচ হাজার ৪৪৬ হেক্টর জমি। ৭ হাজার ৪৬৭ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১লাখ ৮ হাজার ৯২০ মেট্রিক টন। গড়ে হেক্টর প্রতি উৎপাদন হয়েছে ২১ মেট্রিক টন। এর মধ্যে সদর উপজেলায় এক হাজার ৯৫ হেক্টর, উলিপুরে ৮০০ হেক্টর, চিলমারীতে ১৮ হেক্টর, রৌমারীতে ৮ হেক্টর, রাজিবপুরে ৬ হেক্টর, ভূরুঙ্গামারীতে ৫৫ হেক্টর, নাগেশ্বরীতে ৬২৭ হেক্টর, ফুলবাড়িতে এক হাজার ১০ হেক্টর এবং রাজারহাট উপজেলায় দুই হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে।
শৈত্যপ্রবাহের কারণে প্রায় ১৬ হেক্টর জমিতে আলু লেট ব্লাইট আক্রান্ত হলেও কৃষি বিভাগের পরামর্শে আক্রান্ত জমিতে কীটনাশক ব্যবহার করে দমন করা হয়েছে।
জেলা খামারবাড়ির উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মকবুল হোসেন জানান, জেলায় এবারে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আলু আবাদ হয়েছে। অনেক জায়গায় আগাম আলু তোলা শেষ হয়েছে। বাজারে আলুর দাম ওঠানামা করলেও কৃষক লোকসানের মুখ দেখবে না। কুড়িগ্রামকে খাদ্য উদ্বৃত্ত জেলা হিসেবে অক্ষুণ্ন রাখতে কৃষি বিভাগ সব ধরনের পরামর্শ ও সহযোগিতা করছে।