ফাঁসির ইতিহাসে সাত খুন দ্বিতীয়, শীর্ষে বিডিআর বিদ্রোহ

ফাঁসির ইতিহাসে সাত খুন দ্বিতীয়, শীর্ষে বিডিআর বিদ্রোহ

এক মামলায় এত বেশিসংখ্যক আসামির ফাঁসির আদেশের ঘটনা বাংলাদেশে দ্বিতীয়। নারায়ণগঞ্জে চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলায় মোট আসামির ৩৫ জনের মধ্যে ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড (ফাঁসির) দিয়েছেন আদালত।

সবচেয়ে বেশি আসামির মৃত্যুদণ্ড প্রদানে শীর্ষে রয়েছে বিডিআর বিদ্রোহ মামলার রায়। সেনা কর্মকর্তা হত্যার ঘটনায় দায়ের করা ওই মামলায় ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ওই রায়ে সৃষ্টি হয়েছিল একটি ইতিহাস।

দেশে-বিদেশে কোথাও কোনো একক মামলায় এতজন আসামিকে এর আগে কখনও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়নি। এক মামলায় একসঙ্গে এত লোকের সাজাও হয়নি।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘আমার মনে হয়, সবচেয়ে বেশিসংখ্যক আসামির দিকে দিয়ে (ফাঁসির আসামি) প্রথম স্থানে রয়েছে (বিডিআর বিদ্রোহ) সেনা কর্মকর্তা হত্যার অভিযোগে দায়ের করা মামলা। পরের স্থানেই রয়েছে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় ৩৫ আসামির মধ্যে ২৬ জনের ফাঁসির রায় ঘোষণা।’

তৃতীয় স্থানে রয়েছে টঙ্গীর জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলা। এ মামলায় ২২ জনের ফাঁসির নির্দেশ দিয়েছিলেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নুর উদ্দিন। ২০০৫ সালের ১৬ এপ্রিল দেয়া এ রায়ে টঙ্গীর বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম সরকারসহ ২২ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দেয়া হয়।

Mamla
চতুর্থ স্থানে রয়েছে ২০০৬ সালের ২৪ আগস্ট নাটোরের আলোচিত সাব্বির আহমেদ গামা হত্যা মামলায় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এস এম ফিরোজসহ ২১ জনকে ফাঁসির নির্দেশ দেন। সন্ত্রাসীদের গুলিতে ২০০৪ সালের ২৪ আগস্ট নিহত হন গামা। তিনি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের তৎকালীন উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর ভাতিজা। ২১ আসামির ২০ জনকেই বর্তমান সরকারের আমলে রাষ্ট্রপতি সাধারণ ক্ষমা করে দেন। আসামি আকবর হোসেন এখনও পলাতক। তাকে ক্ষমা করা হয়নি।

পঞ্চম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালত কর্নেল ফারুক, মেজর ডালিমসহ ১৫ জনকে ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে হাইকোর্ট তাদের ফাঁসির নির্দেশ দেন। ইতোমধ্যে পাঁচজনের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে।

২০০১ সালে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থানার বাগড়া এলাকায় দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে খুন হন বিএনপির থানা সহ-সভাপতি মনোয়ার আলীসহ পাঁচজন। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে এ মামলার বিচার শেষ হয় ২০০৫ সালের ১২ জুলাই। স্থানীয় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আইয়ুব আলীসহ ১৫ জনকে এ মামলায় ফাঁসির নির্দেশ দেয়া হয়। পরবর্তীতে ১০ জনকে হাইকোর্ট খালাস দেন।

বগুড়ার ধুনটের বড়চাপটা গ্রামে ২০০৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আবদুল বাকী ও তার দুই ছেলেকে খুন করে সন্ত্রাসীরা। রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ২০০৭ সালের ৬ জানুয়ারি আবদুর রশিদ, সাইফুল ইসলামসহ ১২ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। কিন্তু হাইকোর্ট এই ১২ আসামিকে খালাস দেন। ২০০৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি চুয়াডাঙ্গার তিন হত্যা মামলায় (ট্রিপল মার্ডার কেস) স্থানীয় ফজলু, এহিয়া খানসহ ১২ জনকে ফাঁসির নির্দেশ দেন দায়রা আদালত।

বিডিআর বিদ্রোহে সেনা কর্মকর্তা হত্যা মামলার রায়
২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর পিলখানা হত্যা মামলার রায়ে ১৫২ জনের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআরের উপ-সহকারী পরিচালক তৌহিদুল আলমসহ ১৫২ জওয়ান ও নন-কমিশন্ড কর্মকর্তার মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় ওই রায়ে। পাশাপাশি তাদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়।

Mamla
এ মামলার সাড়ে আটশ আসামির মধ্যে জীবিত আছেন ৮৪৬ জন। তাদের মধ্যে ১৬১ জনকে দেয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু ও আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড নেতা তোরাব আলীও রয়েছেন যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে। তাদের দুজনকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও পাঁচ বছর কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন বিচারক।

১৬১ জন আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি অস্ত্র লুটের দায়ে আরও ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং ২০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও দুই বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। তাদের পর্যায়ক্রমে এ সাজা খাটতে হবে। এছাড়া ২৫৬ আসামিকে তিন থেকে ১০ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। কারও কারও সাজা হয়েছে একাধিক ধারায়। অপরাধ সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় রায়ে ২৭৭ জনকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন বিচারক। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের স্থানীয় কয়েকজন নেতাও এ মামলার আসামি।

এক রায়ে এত আসামির ফাঁসির আদেশ বাংলাদেশে এই প্রথম। এমনকি বিশ্বে কোনো মামলায় একসঙ্গে এত আসামির ফাঁসির নির্দেশ দেয়া হয়েছে কি না সে ধরনের কোনো রেকর্ডও নেই। কেউ কেউ মনে করেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দায়ের করা মামলায় অনেককে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলেও হতে পারে। তবে সে ধরনের কোনো রেকর্ড নেই।

নারায়ণগঞ্জে সাত খুন ঘটনার রায়
নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুনের মামলায় সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও র‌্যাবের সাবেক কর্মকর্তা লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদসহ ২৬ জনকে ফাঁসি দিয়েছেন বিচারিক আদালত। বাকি ৯ আসামির সবাইকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। সোমবার নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন এ রায় ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণার সময় মামলার ৩৫ আসামির মধ্যে গ্রেফতার ২৩ জন আদালতে উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে ১৭ জনই র‌্যাবের সাবেক সদস্য।
Mamla

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলা
১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের ২৩ বছর পর বিচারিক আদালতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার সম্পন্ন হয়। হুমকি, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং প্রলোভন সত্ত্বেও আদালত মাথা নত করেননি। সেই ঐতিহাসিক রায় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির ভিত্তি স্থাপন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করে।

১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। ২৩ জুন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দীর্ঘ একুশ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। ২৮ জুন বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত ৬ জনসহ ৯ কূটনীতিককে (জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সেসব খুনিদের কূটনীতিকের চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন) দেশে তলব করা হয়।

১৯৯৬ সালের ১৩ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি কর্নেল(অব.) ফারুক, শাহরিয়ার ও খায়রুজ্জামানকে গ্রেফতার এবং ৩১ আগস্ট ধানমন্ডি থানায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে মামলা করা হয়। ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় আরেকটি মামলা করা হয়। আর ওই বছর ১২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি বাতিল বিল পাস হয়।

এই বিলের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করলে ১৯৯৭ সালের ২৮ জানুয়ারি হাইকোর্ট ইনডেমনিটি বাতিল আইনকে বৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। দীর্ঘ একুশ বছর পর বাঙালি জাতি একটি বর্বর অধ্যাদেশের কলঙ্ক থেকে মুক্ত হয়। তদন্ত শেষে ১৯৯৭ সালের ২১ এপ্রিল নিম্ন আদালতে প্রচলিত আইনে শুরু হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার। দীর্ঘ শুনানি, জেরা ও উভয়পক্ষের আইনজীবীদের সওয়াল জবাব শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর বিচারিক আদালত বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মামলায় ১৫ জন অপরাধীকে প্রকাশ্যে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন।

Featured